আলোচনা-সমালোচনা

আলোচনা-সমালোচনা
 
জোড়াসাঁকো
সংখ্যা ৩। নভেম্বর ২০০৮
প্রধান সম্পাদক: রিজোয়ান মাহমুদ
সম্পাদক: সাজিদুল হক
প্রচ্ছদ: শিল্পী এস এম সুলতানের চিত্র অবলম্বনে।
মোমিন রোড়, চট্টগ্রাম

মনিরুল মনির
সাহিত্যকাগজ ও জোড়াসাঁকো: একটি নিবিষ্ট পাঠ
কত-শত মানুষের কাছে কবিতা লেখার প্রণোদনা পেয়েছি, তা বলে বোঝানো যাবে না। এখন কবিতা লিখি না, লিখতেও পারি না। সময়টা আয়ত্তে আনতে পারছি না। মানুষ নেই। হাহাকার আছে, কষ্টসংশ্লিষ্ট ক’জন সেপাইও আছেন। তাঁদের বঞ্চনা-গাথা নিয়ে বের হবার কথা ছিল ছোটকাগজ। লেখকদের দ্রোহ-তাপ-ঘামে ভেজা যাতনায় সয়লাব হবে শাদা-কুমারী কাগজ, এমন আশা করেছিলাম। কিন্তু বঞ্চিতরা উবে যান, জুড়ে বসে মিডিয়ার ভোঁতাকাঁচিমার্কা বুদ্ধিবাজ তোষামোদিগণ। আহা! শান্তিপাঠ। এখন আকালের প্রাণিত বিজ্ঞাপন। সুন্দরীর নিতম্ব দোলানো টানটান উত্তেজনা। হায়রে ছোটকাগজ, হায়রে সম্পাদনা।
কত-শত তালি-ফালি লেখক এসে বাংলা একাডেমীর পুরস্কারে থাবা মারলো। একটুখানি লজ্জা কি জাতীয়করণ হলো না? জমাট রইলো থু থু, মুছবে কে? কে কাকে আশার বাণী শোনাবে? সবাইতো বাজিয়ে দেখতে চায় মোহনবাঁশিটি। ওহ্! বানিয়ে বানিয়ে আর কতো মিথ্যুক হবো আমরা! লেখা এখন বানানো হয়। লেখা এখন সৃজনের আওতায় পড়ে না। সৃজন কি সবজি চাষ, করলাম আর খেলাম? এই আকালের ঘরে গদ্য পাওয়াও দুষ্কর। তবু কোনো কাগজ গদ্যের আয়োজন করে। যেন অযথা প্যানপ্যানানি।
সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে কয়েকটি কাগজ। এদের মধ্য থেকে নির্ধারণ করলাম জোড়াসাঁকো কাগজটি নিয়ে অল্প কথা বলবার। স্রেফ কথা। কথাগুলো যদি কারো ভালো লাগে তো ভালো, ভালো না লাগলেও ভালো।

জোড়াসাঁকো সদ্য তুলে আনা কচুরিপানার মতো গন্ধ বেরোয়
সাঁকোর কাজটি করতে চায় জোড়াসাঁকো। এ-সাঁকোর গুরুত্ব এতটাই যে, লেখকে লেখকে সম্মিলন হবে। কিন্তু এখানে দুটো সাঁকো। মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, বিপরীতে-বিপরীতে গমন করা যাবে। এপার-ওপার যেকোনো পারে যাওয়া যাবে। এখানে চিন্তারও বৈপরীত্য বা দ্বান্দ্বিকতা থাকতে পারে। বিস্তারিত ব্যাখ্যার জন্য পুরো কাগজটি পড়তে হবে। প্রধান সম্পাদক রিজোয়ান মাহমুদ ও সম্পাদক সাজিদুল হক। প্রথমে প্রচ্ছদটির দিকে তাকাই। এটি কি সুলতানের চিত্রকর্ম? যদি হয় তাহলে এমন অস্পষ্ট কেন? এটি সুলতানের অবিকল কর্ম নয়। প্রচ্ছদে সুলতানের নাম ব্যবহার কেন? সুলতান বাংলার মাটিঘেঁষা মননের কৃষক-শিল্পী। বাংলার মাঠে-ঘাটে কৃষকেরা কৃষিকর্ম করেছে সুলতানের চিত্রের মতোই। প্রচ্ছদে রঙের ব্যবহার, লোগো ও লেখার ফন্ট বাজে মনে হয়েছে। আসলে একজন সম্পাদকের চারুকলা বোঝার বা শেখার দরকার হয় না; বোধ, বিবেচনা ও জানা-শোনা থাকলেই হয়। সম্পাদনার ক্ষেত্রে এটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
মূলপাঠে মনোনিবেশ করি। সম্পাদকীয় থেকে একটি কথা টানি: ‘আমাদের এইকালে তেমন নায়ক নেই।’ কেন নায়ক নেই? সন্ধিক্ষণে যে মহানায়কেরা এসেছেন এই তো যথেষ্ট। মহানায়কদের প্রেরণায় নতুন নেতৃত্ব সৃষ্টি হবে। বলতে পারেন, নেতৃত্ব সংকটে ভুগছি আমরা। আমাদের নেতৃত্ব দেবার মানসে ভন্ড-কাপুরুষরা বসে আছে। ক্ষমতার জৌলুস আছে, ঐতিহ্যের লালন নেই। ধর্মকে পুঁজি করে ব্যবসা আছে, রাষ্ট্রীয় ব্যবসা। যেখানে প্রতিক্রিয়াশীল লোকজন ক্ষমতালিপ্সু হয়ে জাতি ধ্বংসের পায়তারা করে। এহেন রাষ্ট্রীয় বিকার অস্থির করে তুলেছে আমাদের। আমরা চিন্তা করার মুহূর্ত হারিয়ে ফেলেছি। যেখানে গণতন্ত্র ও সামাজিকায়নের ক্ষেত্রে ধীশক্তিসম্পন্ন জনগোষ্ঠিও প্রয়োজন যারা সরকারকে ধরতে, বলতে ও টলাতে পারবেন, তা আর কোথায়!




চরাচর
সংখ্যা ২। এপ্রিল ২০০৮
সম্পাদক: দিলীপ দাশ।
প্রচ্ছদ: খালিদ আহসান
প্রসিদ্ধ বাদল শালকর
৩৯ মোমিন রোড়, চট্টগ্রাম

প্রান্ত পলাশ
চরাচর: অস্থির সময়ের চালচিত্র
‘সময় এখন অস্থির’; এরকম সময়ে চরাচর-এর দ্বিতীয় সংখ্যা প্রকাশিত হলো দীর্ঘ কলেবরে, বিষয়বস্তুগত বৈচিত্র্যে। বিস্মৃতপ্রায় পাঠ, গদ্য, মুক্তগদ্য, অনুবাদ গদ্য, কবিতা, অনুবাদ কবিতা, চলচ্চিত্র, চিত্রনাট্য, চিত্রকলা- শিরোনামে বিভিন্নধর্মী লেখা এতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে এবং ‘নারীবিষয়ক প্রচলিত বিধি-বিধানের কথা মাথায় রেখে নারীর প্রকৃত অবস্থা কী তা উপস্থাপন করার’ মানসে চরাচর-এর এ-সংখ্যায় গুরুত্বে সঙ্গেই স্থান পেয়েছে ‘নারী: সাহিত্যে, সমাজে রাষ্ট্রে’ শিরোনামের বিশেষ ক্রোড়পত্র।
শুরুতেই ‘বিস্মৃতপ্রায় কবির বিস্মৃত কাব্য’ শিরোনামে কবি অরুণ দাশগুপ্ত বাংলা সাহিত্যের ‘যুগপ্রতিভূ কবি’ নবীনচন্দ্র সেন-এর ‘নবীন প্রতিভার মূল্যায়ন’ করেছেন। বঙ্কিমচন্দ্র অবকাশরঞ্জিনীকে ‘গীতিকবিতা’ আখ্যা দিয়ে নবীনচন্দ্রকে ‘সুকবি, এবং বিশুদ্ধ রুচি, যশস্বী হইবার যোগ্য’ বলে প্রশংসা করেন। কিন্তু অরুণ দাশগুপ্ত জানান, ‘অবকাশরঞ্জিনী কাব্য কবির অসংযত হৃদয়াবেগ, অকারণ উচ্ছ্বাস, বাহুল্যপূর্ণ উক্তি’ এবং ‘ভাবে ও আঙ্গিকে শিথিল বিন্যস্ত’ হবার কারণেই ‘গীতিকবিতায় উত্তীর্ণ’ হতে পারেনি। তার ভাষায়, অবকাশরঞ্জিনীতে মূলত নবীনচন্দ্র সেনের ‘ব্যক্তিগত আর্তি’ ফুটে উঠেছে, যা ‘তরুণ কবিহৃদয়ের হৃদয়গ্রাহী আত্মোদ্ঘাটন’ মাত্র। কবিতায় ব্যক্তির অনুভবজাত বোধ যদি সামগ্রিক বোধে পরিণত না হয়, তবে তার কাব্যমূল্য তেমন থাকে না। ঐতিহাসিকভাবে নবীনচন্দ্র যতটা গুরুত্বপূর্ণ, কাব্যবিচারে তিনি ততটাই গুরুত্বহীন। সে-কারণে বলা যায়, এ-গদ্যের উদ্দেশ্য শুধুমাত্র সমকালের পাঠককূলের কাছে নবীনচন্দ্রকে পরিচিত করানো ছাড়া বেশি কিছু নয়।