গদ্য

সবুজ তাপস
দৃষ্টান্তবাদী দৃষ্টিতে কবিতার সৌন্দর্যোপভোগযাত্রা


প্রথম পর্ব : অনাকাক্সিত নতুন সমস্যা
কবিতা তত্ত্বস্রষ্টা, তত্ত্ব কবিতাস্রষ্টা। এখানে দুটো কথা। দুটোই সত্য। সত্য বলেই আমরা রোমান্টিসিজম, রিয়ালিজম, ইমপ্রেশনিজম, ফিউচারিজম, সুররিয়ালিজম, এক্সিসটেনসিয়ালিজম ইত্যাদি এবং এসবের প্রভাবে প্রভাবিত কবিতা পেলাম। বর্তমানে আমাদের দু’বাংলার পণ্ডিতরা পাশ্চাত্যের কালসাপে Postmodernism-এর বাংলা পরিভাষা ‘উত্তরআধুনিকতা’ (অবশ্য কোনোকোনো তাত্ত্বিক বলেন, Post modernism ও উত্তরআধুনিকতা এক কথা নয়। তারা ‘উত্তর’ কথাটির ‘পোস্ট’- এই অনুবাদ প্রত্যাখ্যান করে একে বলেন ‘উত্তরণ’ – আধুনিকতা থেকে উত্তরণ১) নিয়ে স্বাধীনতা-উত্তর কাল থেকে এখানকার কবিতার গতি-প্রকৃতি পরিবর্তন বা কবিতাকে মূল রাস্তা দেখিয়ে দেওয়ার কাজ করে যাচ্ছেন! আমার কাছে মনে হচ্ছে, এখানে পাশ্চাত্য আধুনিকতাচর্চাকে বিষফোঁড়া মনে করে তারা শেকড়মুখী হওয়াকে গুরুকাজ ভাবছেন। অথচ ক্যাসিক্যাল, মডার্ন, পোস্টমডার্ন কবিতাপর্ব বাদ দিয়ে বিশ্বপণ্ডিতরা বর্তমানে ল্যাঙ্গুয়েজ পোয়েট্রি, নিউ ফর্মালিজম, ক্রিটিক্যাল থিওরি, মাল্টিকালচারিজম, নিউ ন্যারেটিভ ও আইডেনটিটি পোয়েটিক্স নিয়ে নানারকম পরীা-নিরীা চালাচ্ছেন (কবিতার মানচিত্র ১/আবদুর রব, ১৫ মে ২০০৮, সাপ্তাহিক কাগজ, সম্পাদক- নাঈমুল ইসলাম খান)। আমি এইসব তত্ত্ব-মন্ত্রের মধ্যে আকণ্ঠ না থেকে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ‘দৃষ্টান্তবাদ’ অনুযায়ী কবিতার সৌন্দর্যোপভোগ করবো। দৃষ্টান্তবাদ? এ-দর্শন, আধুনিক ও উত্তরআধুনিক সাহিত্যচর্চার চরম সমর্থক নয়, আবার ঘোরবিরোধীও নয়, এ-দুই চর্চাধারার ইতিবাচক-সৃজনশীল দিকগুলোকে আমলে নিয়ে, অন্ধকারমুখিতা-পশ্চাৎমুখিতাকে সমালোচনা করে পাঠককে (সমাজকে) তর্কপ্রিয়-যুক্তিপ্রিয় বা মুক্তিযোদ্ধা-যুক্তিযোদ্ধা করে তোলার দর্শন। এ-দর্শন অস্পৃশ্য-অদৃশ্য বিষয়ের নয়, বাস্তব বিষয়ের অবতারণা করে মুন্সিয়ানা দেখানোর পপাতী (Drishtantoism, neither a blind exponent of modern and postmodern literature nor an extreme opponent of them, wants to make the readers (or the society) argument-prone and freedom-loving. This philosophy takes importantly the positive-creative aspects of the mentioned two flows of literature criticizing their existing backwardness & darkwardness, and extremely supports the exposition of thing-based reality ignoring every intangibility and invisibility.)। বলে রাখি, ‘দশক দর্শন : শামসুর রহমান নব্বই দশকের কবি’(চরাচর, এপ্রিল ২০০৮, সম্পাদক- দিলীপ দাশ, পৃ. ১৪৩-১৫৪)শিরোনামে মুক্তগদ্য লেখার পর কবিতার সৌন্দর্যবিষয়ে এ-জাতীয় একটা গদ্য লেখার ইচ্ছা পোষণ করি। বিশেষ করে সত্তর থেকে বিভিন্ন কালখণ্ডে লিখতে আসা কবিদের কবিতার ওপর। লিখতে গিয়ে এক অনাকাক্সিত সমস্যার সম্মুখীন হয়ে থমকে দাঁড়াই। কবিতার সৌন্দর্যবিষয়ে লিখতে গেলে কবিতার উদ্ধৃতি রাখতে হয় এবং তার অনুকূলে বোধমতো একটা বক্তব্যও দিতে হয়। সমস্যাটা এখানেই : উদ্ধৃতিটি যার নামে ছেড়ে দিতে যাচ্ছি তা কি আদৌ তার না অন্য কারুর কবিতার- সন্দেহ থাকছে। এই পর্বে, স্থূল দাগে, অপ্রত্যাশিত এ সমস্যা নিয়ে বক্তব্য রাখা থাক।
পরোভাবে যে-সমস্যা আমাকে কাব্যসৌন্দর্যোপভোগযাত্রায় বাধা দিচ্ছে, উল্লেখ করলাম, তার সরেস-সমৃদ্ধ ব্যাখ্যা দেয়ার পে সহায়ক গদ্য হিসেবে হাতের কাছে পেয়েছি আবু হাসান শাহরিয়ারের ‘কবিতা অকবিতা অল্পকবিতা’। সুতরাং গদ্যটির যৎসামান্য মূল্যায়ন ক’রে অগ্রসর হওয়া যাক। আবু হাসান শাহরিয়ার তার এ-গদ্যে রণজিৎ দাশের ‘শ্মশানছবি’র সাথে ফরিদ কবিরের ‘দেয়ালবন্ধুরা’ তুলে ধরেছেন এবং বলেছেন, ‘দশক-বিচারী প্রাবন্ধিকদের কেউ কেউ বলেন, গত শতকের আশির দশকের কবিরা (বাংলাদেশে) কবিতায় নতুন বাঁকের সন্ধান করেছিলেন। যত না বাঁক, তার চেয়ে বেশি অনুসরণের ঘটনাই ঘটেছে ঐ কালখণ্ডে। … ফরিদ কবির ঐ কালখণ্ডেরই জাতক’। অনুসরণ বলতে তিনি কবিতাকে সামনে রেখে কারোর বানানো কবিতা নির্দেশ করেছেন। এ-যে বক্তব্য, তার যাথার্থ্য এজাজ ইউসুফীর একটা নোটেও পাই। নোটটা, দৈনিক পূর্বকোণ-এর ‘সাহিত্য ও সংস্কৃতি’ পাতায় ৬ জুলাই ২০০৭-এ প্রকাশিত আমার ‘কথাটা প্যারাডক্স হলো’ শিরোনামের একটি পাঠ-প্রতিক্রিয়ামূলক গদ্যের নিচে ছিল : ‘কবিতার অধরসুধপান করতে সম্প্রতি এক অদ্ভুত কুম্ভিলকবৃত্তির প্রতিযোগিতা দেখা দিয়েছে। অনেকেই আশির দশকে এই কাজটি অহরহ করতো। কিন্তু কখনও তা ঘাঁটার চেষ্টা করিনি …’। আবু হাসান শাহরিয়ারের মতের সাথে এজাজ ইউসুফীর এ-মত যোগ করে, শুধু আমি নই, যে-কোনো কাব্যপাঠকই বলতে পারেন : উল্লেখিত দশকে বাংলা সাহিত্য কোনো স্বতন্ত্রকাব্যভাষী-শক্তিমান কবি পেল না!
আবু হাসান শাহরিয়ার এ-গদ্যে শুধু আশির দশক নয়, অন্যান্য কালখণ্ডেও-যে এ-অনুসরণের ঘটনা ঘটেছে, তার সপ্রমাণ ব্যাখ্যা দিতেও নিরত হয়েছেন। প্রমাণস্বরূপ তুলে ধরেছেন শঙ্খ ঘোষের ‘প্রতিহিংসা’ ও পূর্ণেন্দু পত্রীর ‘যে টেলিফোন আসার কথা’ র অংশবিশেষের সাথে যথাক্রমে সিকদার আমিনুল হকের ‘স্মৃতি’ ও ওমর কায়সারের ‘চন্দ্র এখন পর্দানশীল’র অংশবিশেষের সাযুজ্য। এবং এর দ্বারা তিনি শেষোক্ত দুজনকে ‘নবিশ কবি’ বলার (…)সাহস দেখিয়েছেন। এ-েত্র স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, অংশবিশেষের সাযুজ্য ও কিছু শব্দচিত্রের অভিন্নতা দেখিয়ে কি কাউকে ‘নবিশ কবি’ বলা যায়? এ-জাতীয় প্রশ্নের জবাব দুটো – ‘হ্যাঁ’ ও ‘না’। পাঠক ‘না’ বলার পে কিনা- জানি না। যদি এর জবাব ‘হ্যাঁ’ হয়, তবে আমি আবু হাসান শাহরিয়ারকেও একই অভিধা দিতে পারি। তার মধ্যেও এমন কিছু ল করি, যেগুলোর অংশবিশেষ অন্যের কাছ থেকে নেয়া, অনুসরণজাত। উদাহরণস্বরূপ তার একলব্যের পুনরুত্থান-এর ‘অকুলচারীর পাঠ্যসূচি’ তুলে ধরতে পারি। একে শঙ্খ ঘোষের ‘তুমি’র পরে পড়লে যেকোনো কাব্যপাঠক তার গায়েও তার আবিসকৃত ‘নবিশ কবি’ সিলটির ছাপ রাখতে প্রণোদিত হবেন।
আমি উড়ে বেড়াই আমি ঘুরে বেড়াই
আমি সমস্ত দিনমান পথে পথে পুড়ে বেড়াই
কিন্তু আমার ভালো লাগে না যদি ঘরে ফিরে না দেখতে পাই
তুমি আছো তুমি।
(তুমি/ শঙ্খ ঘোষ)
এবং
আমি উড়ে বেড়াই
উড়ে উড়েই ঘুরে বেড়াই
… … …
তাই আগুনে হাত রাখলে আগুন নিজেই পোড়ে।
আর রক্তগোলাপ ফোটে জমাট শ্বেতপাথরে।
আমি উড়ে বেড়াই
উড়ে উড়েই ঘুরে বেড়াই
কালে-কালান্তরে
ধর্মে আমার কুলায় না তাই থাকি বৃহত্তরে।
(অকুলচারীর পাঠ্যসূচি/আবু হাসান শাহরিয়ার)
এই-যে ব্যাপার, এ-েেত্র আমি এখানে-ওখানে আত্মশ্লাঘাকারী আবু হাসান শাহরিয়ারের মতোই বলতে পারি: ‘চেতনেই হোক আর অবচেতনেই হোক, এ জাতীয় অনুসরণের কবল থেকে নিজেকে মুক্ত রাখাও কবির কর্তব্যের অংশ…’। উপরে শঙ্খ ঘোষের ‘তুমি’তে ল করি তার তুমিতে সীমাবদ্ধ থাকার ইচ্ছাবোধ আর আবু হাসান শাহরিয়ারের ‘অকুলচারীর পাঠ্যসূচি’তে তার বৃহত্তর পরিসরে অবস্থান নেয়ার স্বীকৃতিজ্ঞাপন। ল্যণীয় পার্থক্য কেবল বিশেষ (Particular) এবং সামান্যের (Universal)।
আবু হাসান শাহরিয়ার এলিয়টের বরাত দিয়ে বলেছেন, ‘নবিশ কবিরা নকল করে, আর পাকা হাতের কবিরা করে চুরি’। তার এ-উদ্ধার থেকে বোঝা যায়, কাঁচা হাতের কবিরাই নবিশ কবি। কিন্তু এ-গদ্যে তিনি কারোর একটি কবিতায় পূর্ণাঙ্গ নকলরূপ তুলে ধরতে সম হননি। পূর্ণাঙ্গ নকল হিসেবে আমি উত্তরআধুনিক আশীষ সেনের ‘এক কান্ত পদাতিক’ (২০০৭, আদিত্য প্রকাশন, চট্টগ্রাম) কাব্যের ‘মশালের আলোয় দেখা’, ‘আমার স্বপ্ন ও আমার পৃথিবী’ এবং ‘ভালোবাসার মতন’ নির্দেশ করতে পারি। এখানে কেবল প্রয়াত খান শফিকুল মান্নানের ‘কখনো কোথাও’ (পদাতিক, একুশে সংখ্যা, ১৯৭৮, সম্পাদক- মাহাবুব-উল-আজাদ চৌধুরী)-এর সাথে আশীষ সেনের ‘মশালের আলোয় দেখা’ পড়া যাক-
কখনো কোথাও মাহুত মাতাল হয়/ম্যাপের কোনায় রক্ত ফিনকি দিয়ে
কখনো কোথাও লালের আভাস রাখে/কখনো কোথাও হরিণ পালায় বনে
খাতার পাতায় ঝড়েরা বন্দী থাকে/মোমের বাতিটি নীরবে জ্বলিয়া যায়
প্রাচীন প্রাণীর লেজের মহিমা আজো/বঙ্গসাগর উথাল পাতাল করে
ছুটেছে মহিষ লবণ মাঠের বুকে/বেপথু ঝড়ের ছোবল বারংবার
বিপুল নখরে ছিঁড়েছে সাইকলপ্স/ইথাকা এখনো বিরান পাহাড়ভূমি
বেদিয়া পাখীরা অনেক গাঙের চিল/হাতিরা কখনো মাঝারি শূকর হয়
কখনো ইঁদুর বিলাসী হোটেল ঘরে/অশোক কাননে সোনার লঙ্কা জ্বলে।
(কখনো কোথাও/খান শফিকুল মান্নান)
এবং
কখনো কোথাও মাহুত মাতাল হয়/ম্যাপের হৃদয়ে রক্ত ফিনকি দিয়ে
কখনো সে লাল ভোরের আভাস রাখে/জাগে লোকালয় হরিণ পালায় বনে।
খাতার পাতায় ঝড়েরা বন্দী থাকে।/মোমের বাতিটি নীরবে জ্বলে ফুরায়
প্রাচীন প্রাণীর লেজের তাড়ন আজো/বঙ্গসাগর উথাল-পাতাল করে।
ছুটছে মহিষ লবণ মাঠের বুকে/ঝড়ো খুরে হানে ছোবল বারংবার,
সুবিধাবাদীরা ছিঁড়ছে পুঁথির পাতা/শয্যাসঙ্গী পানাহার হলাহল।
ইথাকা এখনো বিরান পাহাড়ভূমি/বেদে-পাখিরাও খোঁজে নিজ বাসাবাড়ি
হস্তী কি কভু শুকরের পাল হয়/রাজা হতে কভু ইঁদুর নাহি তো পারে।
অশোক কানন নিরাপদ যতো হোক,/ তবুও সেখানে সোনার লঙ্কা জ্বলে।
(মশালের আলোয় দেখা/আশীষ সেন)
আবু হাসান শাহরিয়ার পাকা হাতের কবির চুরিকর্ম হিসেবে জয় গোস্বামীর‘দাগী’ এবং ময়ুখ চৌধুরীর চন্দ্রমল্লিকার বাড়ি’ নির্দেশ করেছেন। এগুলো যে তাদের চৌর্যবৃত্তিক ফসল, প্রমাণের স্বার্থে তুলে ধরেছেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘উত্তরাধিকার’ ও আবিদ আজাদের ‘কবিতার দিকে’। সত্যিই কাব্যপাঠকের কাছে মনে হবে, ‘উত্তরাধিকার’ থেকেই জন্ম নিয়েছে ‘দাগী’। ময়ুখ চৌধুরীর ‘চন্দ্রমল্লিকার বাড়ি’ নিয়ে তিনি যা বলেছেন, তাও বক্তব্য। তবে আমার কাছে মনে হচ্ছে, তিনি (ময়ুখ চৌধুরী) আবিদ আজাদের ‘কবিতার দিকে’ ও শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ‘কোনদিনই পাবে না আমাকেই-’কে সামনে রেখে ‘চন্দ্রমল্লিকার বাড়ি’ পৌঁছলেন।
চন্দ্রমল্লিকার মাংস ঝরে আছে ঘাসে/ ‘সে যেন এমনি চলে আসে’
হিমের নরম মোম হাঁটু ভেঙে কাৎ/পেট্টলের গন্ধ পাই এদিকে দৈবাৎ
কাছাকাছি/নিজের মনের কাছে নিত্য বসে আছি
দেয়ালে দেয়ালে/হাটের কাচকড় কুপি অনেকেই জ্বালে
নিভন্ত লন্ঠন/অস্তিত্ব সজাগ করে বারান্দার কোণ
বসে থাকে/কোনদিন পাবে না আমাকে-
‘কোনদিনই পাবে না আমাকে!’
(কোনদিনই পাবে না আমাকে-/শক্তি চট্টোপাধ্যায়)
- কোনদিকে যাবে, বাঁয়ে?
- না।
- কোনদিকে যাবে, ডানে?
- না।
- কোনদিকে যাবে, উত্তরে দেিণ পুবে পশ্চিমে?
- আমি কবিতার দিকে যাবো।
- কোন পথে যাবে?
- সবপথে যাবো, সবপথই গেছে কবিতার দিকে।
(কবিতার দিকে/আবিদ আজাদ)
শক্তির কবিতার ‘চন্দ্রমল্লিকা’, ‘কোনদিন পাবে না আমাকে’ এবং আবিদ আজাদের কবিতার স্ট্রাকচার, ‘সবপথে যাবো, সবপথই গেছে কবিতার দিকে’ মাথায় রেখে ময়ুখ চৌধুরীর ‘চন্দ্রমল্লিকার বাড়ি’ পড়া যাক-
- এই রিক্সা যাবে নাকি?/- যাবো স্যার; কোথায় যাবেন?
- যাবো চন্দ্রমল্লিকার বাড়ি।
এই বলে খুব তাড়াতাড়ি/রিক্সায় বসেছি ছেপে; দেখেছি ঘড়িটা বারবার।
যদিও এখান থেকে কোলকাতার ডায়মন্ড হার্বার/
বহুদূর, তবু আমি আরেক কাউকে/খুঁজে ফিরি এ শহরে এখানে ওখানে-
চিত্রপ্রদর্শনী, মিনি সুপার মার্কেট কিংবা বইয়ের দোকান;
ততণে চন্দ্রকলা মেঘের আড়ালে।
- এবার কোন্ দিকে স্যার?
- সবদিকে যাও। চন্দ্রমল্লিকা যেহেতু নেই কোনোখানে,
তার মানে সবদিকে আছে।/তুমি আরও যেতে থাকো,-
আকাশে আরেক চন্দ্রমল্লিকার ইশারা তো পাবে!
চন্দ্রমল্লিকার বাড়ি বুকের ভেতর নিয়ে/পাল্টে দিই সড়কের নাম;
এইভাবে পথে-পথে প্রতিটি গলির মোড়ে
অন্যনামে খোঁজ করি ক্রিসেনথিমাম।/রেখে যাই প্রণয়প্রণাম।
২. ক.
এবার কয়েকটি কবিতার উপর ব্যক্তিক উপলদ্ধি তুলে ধরার পাশাপাশি, আবু হাসান শাহরিয়ারের মতো কাউকে নবিশ কবি (অপরিপক্ক কবি) কাউকে পরিপক্ক কবি না-বলে, সমসময়ের কয়েকজনের কবিতা সামনে আনা যাক।
ময়ুখ চৌধুরী ‘মা বলেছেন’(অর্ধেক রয়েছি জলে অর্ধেক জালে, ১৯৯১, পৃ. ৫৪)-এর মাধ্যমে একটি চমৎকার দৃশ্যকল্প হাজির করেছেন। এখানে দু’টি দৃশ্যের খানিক উপমিতি তুলে ধরার মাধ্যমে, গোত্রপরিচয় দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে। ‘তারা কাঁদছে’ এবং ‘মা কাঁদছেন’ দ্বারা ‘মা হচ্ছেন তারা’ বা ‘তারা হচ্ছে মা’ প্রমাণ করে আংকিক বা সহানুমানিক (Syllogistic) সিদ্ধান্ত টানা হয়নি। কবিতারূপ দেওয়ার জন্য দুটো বচনকে ‘তবে কি মা, তুমি তারার বোন’ এ রূপান্তরিত করা হয়েছে।
মা বলেছেন যাসনে খোকা ছাদে
ঐখানেতে রাতবিরেতে তারারা সব কাঁদে
তবে কি মা, তুমি তারার বোন
অনেক আগে দেখেছিলাম কাঁদতে
সাী আছে স্তব্ধ সিঁড়ির কোণ।
(মা বলেছেন/ময়ুখ চৌধুরী)
শিশুটি যে মাকে তারার বোন বলে বসবে – একথা মায়ের অজানা ছিল। আবার শিশুটির অজানা ছিল- ছাদে গিয়ে তারার কান্না দেখে কাঁদতে শুরু করলে মায়ের সাথে (তার বোধঅনুযায়ী) তার মা-সন্তান সম্পর্কে অনৈক্য তৈরি হবে কিনা। (বাস্তবে মা কি তারার বোন? তারারা কি কাঁদে?)। শিশুরা কাণ্ডজ্ঞানশূন্য বলে তারার কান্নার সাথে মায়ের কান্নার সাযুজ্য পেয়ে যেমন মাকে তারার বোন বলতে পারে, তেমনি বাসার পাশে খুঁজে পাওয়া পরিত্যক্ত কিছু মুখে নিয়ে ফুলিয়ে-উড়িয়ে মজা করতে পারে। এখানে, মনে হচ্ছে, কাণ্ডজ্ঞান তৈরি হবার আগে একটি শিশুর মানসিক অবস্থা কিরূপ থাকতে পারে, তার একটি কাব্যিক উদাহরণ তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। সমসাময়িক ফুয়াদ হাসানের ‘অবুঝ প্রশ্ন-উত্তর’(সাহিত্য সাপ্তাহিকী, দৈনিক আজাদী, ১৬ এপ্রিল ২০০৪) ময়ুখ চৌধুরীর এ-কবিতার মতো সমান ভাবপ্রকাশকারী।
কান্নারত মুনাজাত শেষ হলে
অবুঝ শিশুটি মাকে জিজ্ঞেস করে
‘খোদা কোথায় থাকেন?
মায়ের উত্তর- ‘ঐ আকাশে…’
অঝড় বৃষ্টি দেখে
শিশুটিও বলে বসে,
‘তোমার কান্না দেখে খোদা বুঝি কাঁদেন!’
(অবুঝ প্রশ্ন-উত্তর/ফুয়াদ হাসান)
‘কান্নারত’ শব্দটির অনুপযুক্ত ব্যবহারের কারণে ‘অবুঝ প্রশ্ন-উত্তর’ এর প্রথম স্তবক সুশ্রাব্য নয়। শব্দের অনুপযুক্ত ব্যবহারজনিত সমস্যাও কবিতার সৌন্দর্যোপভোগ যাাত্রাপথের বাধা, এখানে বলে রাখা যাক। এ-বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা পরবর্তী পর্বে থাকছে। এখন উপর্যুক্ত কবিতাটি কিভাবে ‘মা বলেছেন’ কিসিমের সমীকরণের সাহায্যে দেখানো যাক-
ছাদ = আকাশ
ছাদে গিয়ে শিশুর তারার কান্না দেখা = আকাশে খোদা থাকেন,
আকাশ হতে বৃষ্টি পড়তে দেখা
মায়ের কান্না দেখা = মোনাজাতরত মায়ের কান্না দেখা
তুমি তারার বোন = খোদা কাঁদেন।
আবু হাসান শাহরিয়ারের নিরন্তরের ষষ্ঠীপদী কাব্যগ্রন্থের ‘১’ চিহ্নিত অংশটি পড়া যাক। এখানে পরোভাবে এখনকার নারীদের বিষয়াসক্তির আতিশয্য তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।
কেউ তোমাকে মোহর দেবে, কেউ দেবে ভাগ রাজ্যপাটে
কেউ বসাবো সিংহাসনে, কেউ বসাবে সোনার খাটে
কেউ পরারে রুপোর খাড়–, কেউ পরাবে সাতনরী হার
যার কিছু নেই সে-ও ওড়াবে হাজার ফানুস বিমুগ্ধতার
দু’চার পঙ্ক্তি কাব্য ছাড়া আমার দেবার আর কি আছে?
নরস কাব্যগ্রন্থ পুরে পাঠিয়ে দেব তোমার কাছে।
কালিদাস-কমলার বৈবাহিক জীবনের প্রারম্ভিক পর্বের একটি ঘটনা সম্পর্কে কেউ কেউ অবগত। ঘটকের চাতুর্যপূর্ণ ঘটকালির মাধ্যমে কালিদাস কমলাকে বিয়ে করে বাসরঘর পর্যন্ত পৌঁছতে পেরেছেন। কিন্তু কমলা তাকে জলযোগ না-দিয়ে এই বলে তাড়িয়ে দেন যে, যে-দিন জ্ঞানে-বিদ্যায় অদ্বিতীয় হয়ে আসবেন, সে-দিন তাকে আশা করা যাবে। কালিদাস এমন জ্ঞানী হয়ে কমলার সহবাস পেলেন, তার হাত থেকেই আমরা পেলাম মেঘদূতম। উপর্যুক্ত কবিতায় ল করি, বর্তমানের এক কালিদাস পূর্বের এই কমলার চাহিদা (আকাক্সা) অনুযায়ী জৈবনিক যোগ-বিয়োগের কাজ সারতে চাচ্ছেন। কিন্তু এইকাজে সর্বেেত্র সাফল্য আসবে বলে মনে হয় না। কারণ সেই উজ্জয়িনী এখন নেই, গঙ্গায় অনেক জল গড়িয়েছে। সমাজের বাহ্য পরিবর্তনের পাশাপাশি লণীয় আন্তর্পরিবর্তনই জানিয়ে দিচ্ছে, এখনকার কমলারা মেঘদূতএ নয়, বিলাস নিবাসেই সুখের সন্ধান করে যাবে। সে যা-হোক, শাহরিয়ারের এ-কবিতায় প্রিয়প্রাত্রের কাছে একজন গরিব কবির যে-অভিপ্রায়ের প্রকাশ, ঠিক তা-ই ল করি সমসময়ের চন্দন চৌধুরীর ‘লহো মোর শব্দের অঞ্জলি’তে।
তোমাকে দেবার মত কিছু নেই এই গরিব কবির।
নেই অর্থ-বিত্ত বিষয় আশা প্রতিপত্তি,
গাড়ি নেই, নেই কোন মন-মাতানো আলিশান হাবেলি,
কার্পেট বিছানো ঘর;
দেখো! কৃষ্ণচূড়া ফুটেছে এ হৃদয়ে আমার;
ফুটেছে অপূর্ব শব্দের ফুল, বর্ণমালার ঝর্ণাধারা,
অমর কবিতা।

তোমাকে দেবার মতো আর কি আছে আমার!
নিয়ে যাও এই পাণ্ডুুলিপি, বাক্যমালা
শুদ্ধ শব্দরাশি।
(লহো মোর শব্দের অঞ্জলি/চন্দন চৌধুরী)
চন্দন চৌধুরীর কবিতাটি রয়েছে তার লহো মোর শব্দের অঞ্জলি (১৯৯৯, বিশাকা, ঢাকা) কাব্যগ্রন্থে। উল্লেখ্য, দু’জনের কাব্যগ্রন্থদ্বয় ১৯৯৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকা থেকে প্রকাশিত। গ্রন্থভুক্ত হওয়ার আগে এ-দুটোর কোনটি কখন পত্রপত্রিকায় প্রকাশ পেয়েছে তা অজ্ঞাত। ফলে ধারণার দ্বারস্থ হতে হচ্ছে। হয়ত আবু হাসান শাহরিয়ারের ‘১’ ১৯৯৯ সালের আগে কোনো কাগজে পেয়ে চন্দন চৌধুরী সমভাবের ‘লহো মোর শব্দের অঞ্জলি’ লিখেছেন। এমন করতে পারেন। কারণ তিনি শামসুর রাহমানের ‘তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা’র দৃশ্য নিয়ে ‘সূর্যবন্দনায় কুমারী-জননী’ (ঐ, পৃ. ১৭) রচনার (…)সাহস দেখালেন।
দ্যাখো! দ্যাখো!
গেরামের গফুর মিয়ার ঘুম গ্যাছে পালিয়ে প্রবাসে,
ফরিদ আলীর ঠেলাগাড়ির চাকা ঘুরেনা শহরে এখন,
গরব মুন্সী গরুর গাড়ি চালায় না আর,
দিতি দেবী কপালে লাগায় না সিঁদুর, পরে না শাখা নূপুর,
রহিমা বিবি বাঁধে না বেণী, লালফিতা,
শরীরে মাখে না রয়নার তেল।
এদিকে আবার
মতির থুত্থুরে মা পালিয়েছে ছনের ঘর ছেড়ে,
মনা মাঝি ঘাটের ওপাশে ডুবিয়ে দিয়েছে নৌকা,
ইমন লিমন যায়নি মাঠে ওড়াতে ব্যোম ঘুড়ি।
স্বাধীনতাকামী শত্র“ঘœ-সময়ে বাংলায় হাসেনি কোন মুখচ্ছবি
অনন্ত অন্ধকারের মাঝে এখন যেঁ শিমুল ফুটবে
… তুমি বাংলাদেশ।
(সূর্যবন্দনায় কুমারী-জননী/চন্দন চৌধুরী)
হয়তো এমনও হতে পারে, প্রকাশ-উন্মুখ চন্দন চৌধুরী দৈনিক যুগান্তরের ‘সাহিত্য সাময়িকী’তে প্রকাশ করতে কবিতাটি পাঠিয়েছেন, আবু হাসান শাহরিয়ার তাকে নিজের মতো করে সাজিয়েছেন। তিনি এমন করতেও পারেন। (প্রথম অংশে শঙ্খ ঘোষের ‘তুমি’র সাথে তার ‘অকুলচারীর পাঠ্যসূচি’ তুলে ধরে তা দেখিয়েছি)। আবার এমনও হতে পারে, আমরা কাকতালীয়ভাবে দু’জনের কলম থেকে একই কিছু পেয়ে গেলাম। তবে, এ-েেত্র, বাক্যিক মিল ও উদ্দেশ্যকে অগ্রাহ্য করি কীভাবে? হ্যাঁ, দুজনের কবিতায় একটা শব্দ বা বাক্যের অপ্রত্য মিল খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। এ-মিল থাকা যে দোষের নয়, তা কবিতাদ্বয় পাশাপাশি রেখে পড়লেই আঁচ করা যায়। বাক্যের গঠন, উদ্দেশ্য ইত্যাদি ব্যাপার আমলে নিয়ে যে কোনো কাব্যপাঠক বলতে বাধ্য – কবিতাদ্বয় এক নয়। অনির্বাণ মুখোপাধ্যায়ের উত্তর ঔপনিবেশিক বাংলা কবিতা (বইমেলা-২০০৭, উর্বী প্রকাশন, কলকাতা) গদ্যগ্রন্থের ‘উত্তর ঔপনিবেশিক বাংলার কাব্য-রাজনীতি’ গদ্যে উদ্ধৃত অরণি বসুর ‘বন্ধুর বাড়ি’ কবিতাটি পড়ার পর আবু হাসান শাহরিয়ারের ‘একাকী জীবন হাঁটি আমি আর আমার’ এবং ইতোপূর্বে প্রকাশিত আমার ‘স্বীকারোক্তি’ (প্রথমে মনিরুল মনির সম্পাদিত খড়িমাটির ৫ম সংখ্যা ২০০৭-তে এবং পরে ‘বাঁচনভঙি-২’ শিরোনামে দৈনিক পূর্বকোণএ) কবিতার কথা মনে পড়ল। শাহরিয়ারের কবিতাটি গদ্যকার আবদুর রবের ‘কবিতার মানচিত্র ৬’ (১৯ জুন ২০০৮, সাপ্তাহিক কাগজ, সম্পাদক- নাঈমুল ইসলাম খান)-এ উদ্ধৃত পেয়েছি। নিজের কবিতাটি তুলে না ধরে (অন্যান্যের মতো নিজের কবিতার উদ্ধৃতি তুলে ধরার জন্য গদ্য লিখি না) অরণি বসু ও আবু হাসান শাহরিয়ারের কবিতা সামনে আনা যাক :
যা যা চাও সব পাবে বন্ধুর বাড়িতে:
ভাঙা সোফা, ফড়িং বালক আর দাড়িওয়ালা কাক
সর্বোপরি পাবে এক বালকের ছদ্মবেশে রিটায়ার্ড বুড়ো
মনো সুখ আছে যার আছে পুনঃপুনঃ জ্ঞান বিতরণ।
সকলেই কবি তারা, সকলেই, শুধু সোফা নয়,
সেই ফড়িংও তো কবি
আমি যে তাদেরই বন্ধু, খর্বকায় কৃকলাস
আমিও কি কবি নই? যত কবি রণজিৎ দাশ?
(বন্ধুর বাড়ি/অরণি বসু)
এবং
পাখিরা বাঙ্ময় কবি; প্রকাশিত
গ্রন্থাবলি নেই। চরিতাবিধানে তাই
পাখিদের নাম নেই কোনও । যদিও
কোকিলই আজও পৃথিবীর
জনপ্রিয় কবি। তত্ত্বের ধুতুরা
ফোটে তোমাদের বুদ্ধির বাগানে।
ছাপাখানা থেকে আজ চাররঙা
কভার এসেছে। ঘরে ঘরে চ’লে
যাবে তোমাদের বুদ্ধিবাজ বই।
শিবিরে শিবিরে হবে কবিতার
ভাগ বাটোয়ারা। এখানেই আঁতুড়
ঘর, দ্যূরর শ্মশানে চলে চিতা।
একাকী জীবন হাঁটি আমি আর
আমার কবিতা।
(একাকী জীবন হাঁটি আমি আর আমার/আবু হাসান শাহরিয়ার)
অরণি বসু ও আবু হাসান শাহরিয়ারের উল্লেখিত কবিতায় তাদের কবি স্বীকৃতিপ্রাপ্তির উদ্ব্যক্তি লণীয়। অনির্বাণ মুখোপাধ্যায় অরণি বসুর কবিতাটি তুলে ধরে বলেছেনও : “এই কবিতাটিতে…এক আইকন বন্ধু কবির (দেশ পত্রিকার কবিতার পাতা সম্পাদনার দায়িত্ব যার হাতে ন্যস্ত হয় তাকে আইকন বলা হচ্ছে) দমচাপা বর্ণনা রয়েছে, যেখানে সবাই কবি, খালি সংশয় নিজেকে নিয়ে, নিজের কবিযশের স্বীকৃতি নিয়ে। ‘রণজিৎ দাশ’ এখানে নিমিত্ত মাত্র, শুধুমাত্র তার নামটি এখানে ছন্দরার খাতিরে ব্যবহৃত। যাই হোক না কেন, এ কবিতা যে যশোপ্রার্থী তরুণ কবির হাহাকার ফুটিয়ে তুলেছিল, যে বিষয়ে সন্দেহ নেই।” শাহরিয়ারের কবিতাটির ‘… কোকিলই আজও পৃথিবীর/জনপ্রিয় কবি। তত্ত্বের ধুতুরা/ফোটে তোমাদের বুদ্ধির বাগানে।/…একাকী জীবন হাঁটি আমি আর/আমার কবিতা’ পঙ্ক্তিগুলোতেই পাওয়া যাবে তার কবিসত্তার আত্মজাহিরি। আবদুর রবও বলেছেন, ‘পাখি ও কোকিল (তিনি আলাদা করে দেখিয়েছেন) কবিস্বীকৃতি পেলেও, শাহরিয়ার এদের কাউকে কবি হিসেবে অভিপ্রায় করেননি। এদেরকে কবি বলার উদ্দেশ্য তিনি নিজেই নিজেকে পাখির মতো বাক্সময়, কোকিলের মতো সুকণ্ঠী ও জনপ্রিয় কবি হিসেবে প্রচার করার উদ্দেশ্যে এই গল্প ফেঁদেছেন’। তাদের দু’জনের কবিতার সাথে আমার কবিতার তফাৎ এখানেই : আমার কবিতায় অকপটে স্বীকৃত – ‘আমি কোনো কবি নই’। তারা কেউ ফড়িংকে, কেউ পাখিদের কবি বলেছেন। এ-জায়গায়, অজান্তে, আমার কবিতায় আমি ছাড়া বস্তুজগতের সবকিছু কবি হিসেবে স্বীকৃত। একটা কবিতাকে দুষ্ট বলা যাবে তখনই, যদি এর কিছু বাক্য-শব্দবন্ধ (বাক্যগুলোর মূলভাব-উদ্দেশ্য অনেকটা একই বা শব্দবন্ধগুলো অবিকল) পূর্বপ্রকাশিত অন্য কবিতার সাথে মিলে যায়। এ-ব্যাপারে পরবর্তী অংশে যুৎসই উদাহরণ হাজির করেছি।
২. খ.
শক্তি চট্টোপাধ্যায়-ময়ুখ চৌধুরী-আবু হাসান শাহরিয়ারের কবিতার ওপর চালিত, কয়েকজন অনুজের, দুষ্ক্রিয়া তুলে ধরা যাক। বলে রাখা আবশ্যক যে, এ-আত্মসাৎকারী-আত্মস্থকারীদের সবাই শূন্য দশকের শেষভাগ থেকেই নিয়মিত-অনিয়মিতভাবে পত্র-পত্রিকায় লিখছেন। এখানে বলা অনাবশ্যক যে, দশক দর্শন : শামসুর রাহমান নব্বই দশকের কবি গদ্যে এদের নিকট অগ্রজদের যে চাতুর্য দেখিয়েছি এরা তাদেরই যোগ্য উত্তরসূরী : তীর্থের কাক, হ্যালোপ্রিয়; এবং সাহিত্য পাতা/কাগজ সম্পাদকের আনুকূল্য লাভ করে কবি হওয়ার চেষ্টায় নিরত (কবি হতে চাওয়া কি অপরাধ?)। কবি ও ছবির মধ্যে পার্থক্য করে কোনজনা? সম্পাদকের আনুকূল্য লাভ করে কি কবি হওয়া যায়? দেশকাল দেখে জোড়াসাঁকো পার হয়ে বড়জোড় লেখক (নোয়াখালীতে, যিনি দলিলপত্র লেখেন, তাকেও লেখক বলা হয়) হওয়া যায়- নির্বাহী সম্পাদক কিংবা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্যও হওয়া যায়। বাদুরতলায় বাদুরের মতোন ঝু’লে মেথরপট্টি-টু-সবুজরেস্তোরাঁ হিজরত করে পাণ্ডুলিপিও প্রকাশ করা যায়। এতে আমার সমস্যা কোথায়? নিজেকে ধিক্। বাজে কথা (বাজে কথা?) না-বলে কাজের কথায় আসা যাক।
প্রথম অংশে ময়ুখ চৌধুরীর ‘চন্দ্রমল্লিকার বাড়ি’র উৎপত্তির কথা জানাতে গিয়ে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ‘কোনদিনই পাবে না আমাকে-’ হাজির করলাম। এবার তার (শক্তির) ‘কার জন্যে এসেছেন?’ (শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা, নবম সংস্করণ, জানুয়ারি ২০০২, দে’জ পাবলিশিং, পৃ. ১০২-১০৩) পড়া যাক।
অদ্ভুত ঈশ্বর এসে দাঁড়িয়েছেন মৃন্ময় উঠোনে
একদিকে শিউলির স্তূপ,
অন্যদিকে দ্বাররুদ্ধ প্রাণ-
কার জন্যে এসেছেন-
কেউ কি তা স্পষ্ট ক’রে জানে?
ঈশ্বর গাইছেন গান, তাঁর পথশ্রমে কান্ত ধুলো
লেগে আছে দু’টি পায়,
তবু তা স্পন্দিত হলো নাচে
কয়েকটি ছিট্কেনা ছোটে
চেতনার আনাচে-কানাচে
একটু গেলে, শিমুলের তুলো…
ঈশ্বর কাঁদছেন একা,
সভায় যে কাঁদে সে সংসদে
মানুষের শুভপণ্য বিক্রি ক’রে দেশবন্ধু সাজে
বন্যার আখুটে বালি সভ্যতা গঠনে লাগে কাজে
এই বলে যে ভাষায়
সে কখনো ঈশ্বর দ্যাখে নি!
আমার ঈশ্বর এসে দাঁড়িয়েছেন সবার উঠোনে
একদিকে শিউলির স্তূপ, অন্যদিকে দ্বাররুদ্ধ প্রাণ
কার জন্যে এসেছেন-
কেউ কি তা স্পষ্ট ক’রে জানে?
(কার জন্যে এসেছেন?/শক্তি চট্টোপাধ্যায়)
মৃন্ময় উঠোনে ঈশ্বর গান গাইছেন এবং তালে-তালে তার দু’পায়ের কান্ত ধুলোরাশি নাচছে। আবার এ-ঈশ্বর একটু দূরে ‘শিমুল তুলো’ পাড়ায় গিয়ে কাঁদছেন- ওখানকার মানুষগুলো দু’মুখো আচরণের, যেন তারা তাকে কখনো দেখেনি। শক্তি বলেছেন, তার এ-ঈশ্বর একদিকে শিউলির স্তূপ অন্যদিকে অবরুদ্ধ প্রাণ রেখে সবার উঠোনে কারো অপোয় থাকছেন। এখানে ‘শিউলির স্তূপ’ ও ‘অবরুদ্ধ প্রাণ’ হতে পারে, ভালোমন্দ অথবা স্বর্গ-নরকের প্রতীক। শক্তির উল্লেখিত কবিতাটি দৃষ্টান্তবাদসমর্থিত নয়। এই জন্যে যে, দৃষ্টান্তবাদ বিশ্বাস করে, ‘ঈশ্বর আছেন’ এবং ‘ঈশ্বর নেই’- এ-দুই প্রত্যয়ের কোন্টি বাস্তব সত্য তা চিরকালই অনির্দিষ্ট থাকবে; শুধু এই নিয়ে পরধর্মচর্চায় কেউ-কেউ আস্তিক হবে, কেউ কেউ নাস্তিক। দৃষ্টান্তবাদ আস্তিক্যবাদী নয়, আবার নাস্তিক্যবাদী দর্শনও নয়। এ-হিসেবে ‘জীবে প্রেম করে যেজন সেজন সেবিছে ঈশ্বর’ নয়, এ-মতানুসারে ‘জীবে প্রেম করে যেজন সেজন সেবিছে স্ব-বিশ্ব’ (Of the two propositions, namely “there is God” and “there is no God”, which is really true, Drishtantoism realizes, will remain uncertain for ever. Taking these by the practice of another’s religion some will be theist and some will be atheist. The philosophy is neither theistic nor atheistic philosophy. For this, “to serve creature is to serve own world” is acceptable, but “to serve creature is to serve God” is not.)। শূন্য দশকের শেষভাগে লিখতে আসা কোনো অনুজ যদি শক্তির এ-কবিতাকে ‘ঈশ্বর’১ করে ফেলেন, কেমন দেখাবে?
একবার ঈশ্বর এসেছিলেন/সদ্য ফোটা মৃত্যু নিয়ে
অনেকবার তাকে সরষের বাগানে ঘুরতে দেখে
মৃত্যু হেসেছিল বহু-বিভ্রমে, বহু-তৃপ্তিতে
সরষে ভূত নাকি সরষে সাবাড় করে
ঘোড়াউত্রা নদীর বাঁকে দেখেছি তেমনি সরষের বাগান
যেখানে কাটা কাটা সৌন্দর্য বেচতে চায় মানুষ
মানুষের ভিড়ে ঈশ্বরকে দেখেছি কাঁদতে
জলের মাদুরে বিছানো ফেলবামাত্তর গুল্ম-জমিন
জমিনের দারিদ্র্য-তুমিই কি ঈশ্বর/আজো দুয়ারে দুয়ারে ফিরো, প্রতিায়-
আজো ঈশ্বর দেখিনি, দেখেছি ভূত।
(ঈশ্বর)
শক্তির ‘… ঈশ্বর এসে দাঁড়িয়েছেন…/… শিউলির স্তূপ,/ দ্বাররুদ্ধ প্রাণ/ কার জন্যে এসেছেন’- কে লেখা হয়েছে, -‘একবার ঈশ্বর এসেছিলেন/ সদ্য ফোটা মৃত্যু নিয়ে’। এখানে ‘শিউলি’ কে ফোটার বস্তু এবং ‘দ্বাররুদ্ধ প্রাণ’ কে মৃত্যু অর্থে নেয়া হয়েছে। অদ্ভুত ‘ঈশ্বর’ থেকেই ‘ভূত’-এর জন্ম। ‘একটু গেলে, শিমুলের তুলো…/ ঈশ্বর কাঁদছেন একা’কেই বানানো হয়েছে,- ‘ঘোড়াউত্রা নদীর বাঁকে দেখেছি তেমনি সরষের বাগান…/ মানুষের ভিড়ে ঈশ্বরকে দেখেছি কাঁদতে’। ‘একটু গেলে’-এর স্থলে দূরবর্তী নদী ঘোড়াউত্রার (কিশোরগঞ্জ) ব্যাপার টানতে হয়েছে। আর শিমুলকে করে ফেলা হয়েছে,- ‘সরষে’। শক্তির ‘সভায় যে কাঁদে সে সংসদে/ মানুষের শুভপণ্য বিক্রি ক’রে দেশবন্ধু সাজে’ ও ‘বন্যার আখুটে বালি সভ্যতা গঠনে লাগে কাজে’কেই যথাক্রমে লেখা হয়েছে- ‘যেখানে কাটাকাটা সৌন্দর্য বেচতে চায় মানুষ’ ও ‘জলের মাদুরে বিছানো পেলবামাওর গুল্ম-জমিন/ মানুষের দারিদ্র্যÑতুমিই কি ঈশ্বর’। ‘ঈশ্বর এসে দাঁড়িয়েছেন সবার উঠোনে…/ কার জন্যে এসেছেন’-এর অর্থ : ঈশ্বর সবার দুয়ারে এসে দাঁড়িয়েছেন, কারো প্রতীায়। এ-অর্থ মাথায় রেখে লেখা হয়েছে,- ‘…ঈশ্বর/ আজো দুয়ারে দুয়ারে ফিরো, প্রতীায়’। ‘কার জন্যে এসেছেন?’-এর শেষের দিকে বলা হয়েছে, সবার উঠোনে বা দুয়ারে-দুয়ারে এসে ঈশ্বর যাকে খুঁজছেন, তার প্রকৃত ঠিকানা কেউই জানে না। ব্যাপারটিকে আরেকটি পঙ্ক্তি ‘সে কখনো ঈশ্বর দেখেনি!’-এর সাথে সাযুজ্য রেখে ভিন্নভাবে বলার চালাকি করা হয়েছে : ‘আজও ঈশ্বর দেখিনি, দেখেছি ভূত’।
শক্তি চট্টোপাধ্যায়ারের ‘ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন(অংশ)’(শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা, ঐ, পৃ. ১৩৬-১৩৭)-এর ৭৫, ৮৯, ৯২ ও ৮৮-অংশগুলো একনিমেষে পাঠযোগ্য। এজন্যে যে, এগুলো আকারের দিক থেকে অতি হ্রস্ব এবং পাশাপাশি পৃষ্ঠায় বর্তমান। অংশগুলোতে শক্তি তার সাংসারিক টানাপোড়নে হয়ে যাওয়া বাউলা মনের উছল আবেগ প্রকাশ করেছেন। কোনো তরুণ যদি ব্যাপারটিকে তার (শক্তির) শব্দযুগল-ভাষার সহযোগে (৭৫-এর নকল, ৮৯-এর আত্মস্থপ্রয়োগ, ৯২-এর ‘বাড়ন্ত সংসার’, ৮৮-এর পথনদীর মাছ হওয়ার ইচ্ছাবোধ ও ‘নদী’র অন্ত্যমিল ‘যদি’র উপস্থিতি রেখে) ‘খরার উঠোন ভিজে যদি’২ করে ফেলেন, তাকে দুষিত কর্ম বলা যাবে। এই জন্যে যে, এতে রপ্ত-পরিবর্তিত (গড়ফরভরবফ) ব্যবহার ছাড়া কাব্যপাঠক নতুন কিছু পাচ্ছেন না।
ময়ুখ চৌধুরীর ‘কথাটা’ (প্যারিসের নীলরুটি (২০০১), এ্যাডর্নপাবলিকেশন, ঢাকা-চট্টগ্রাম, পৃ. ৯) পড়া যাক-
আমার এমন কিছু কথা আছে,/যা আমি নিজেকেও বলি না।
ভয় হয়,/যদি মুখ ফসকে বলে দিই কখনো!
২.
তোমাকে একটা কথা বলেছিলাম,/কথাটা আমি বলেছিলাম
মনে মনে।
এটাও ঠিক উচিত হয় নি।
ময়ুখ চৌধুরী এখানে নিজেকে নিজে মনে-মনে বলা একটা কথার অনৌচিত্য নিয়ে আফসোস প্রকাশ করেছেন। এটি, তুমি-র সাথে যে রকম বলা যায়, সে রকম সরল ভাষাদেহের। কোনো অনুুজ যদি একে ‘প্যারাডক্স’৩ শিরোনামে, নিম্নোক্তভাবে, উপস্থাপন করে; তাকে এবং তার কৃতকর্মকে কী বলা যাবে?

মা

এমন কিছু কথা আছে
যা আমি নিজেকেও বলি না
ভয়! বড্ড ভয় হয়
মুখ ফসকে যদি
একদিন
কোনদিন
তোমাকে একটা কথা বলেছিলাম
কথাটা ঠিক বলেছিলাম মনে মনে
এটাও ঠিক…
… উচিত হয়নি।
(প্যারাডক্স)
প্রথম অংশে, এক জায়গায়, ‘কথাটা প্যারাডক্স হলো’ শিরোনামের একটি গদ্যের কথা উল্লেখ করলাম। এটা ‘কথাটা’ ও ‘প্যারাডক্স’র মধ্যে দ্রষ্টব্য-বিস্ময়কর সাযুজ্য পেয়েই লিখতে বাধ্য হলাম। লেখার পর কী ঘটনা ঘটল তা স্মৃতিকথায় উল্লেখ করেছি।
ময়ুখ চৌধুরীর ‘কথাটা’কে আবার যদি কোনো তরুণ ‘বাক্যভয়’৪ শিরোনামে নিম্নোক্তভাবে হাজির করে, তাতেও নতুন কিছু পাবো না। তাতে, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘উত্তরাধিকার’কে জয় গোস্বামী যেভাবে ‘দাগী’ করেছেন, সেভাবে কৃত নিন্দার্হ কর্মের সাাৎই পাবো।
নিজেকে আমার ভয়,
কখন ভদ্রতার রশি ছিঁড়ে পঙ্গপালের মতো
থুথুসমেত বের হ’য়ে আসে/অনুভূতিপ্রবণ বাক্যগুলো
বাক্যেরাও জীবন্ত
ডানার বিস্তারে ছুটে যায় প্রান্তিক শিকড় ছিঁড়ে।
এই শহরে-
মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে ঠায় প্রাসাদ-প্রতিমাগুলো,
তার অন্তরে, বাহিরের পলেস্তরায়
জড় অনুভূতিগুলো/একে-একে খুলেছে সব নিষ্ক্রিয় মুখের লাগাম।
নিজেকে আমার ভয়,
কখন আমিও হ’য়ে উঠি তুখোড় অনুভূতিপ্রবণ।
(বাক্যভয়)
আবু হাসান শাহরিয়ারের ‘নদীকে শাসায় এক অধ্যাপক’ (এবছর পাখিবন্যা হবে ,২০০০, র্যামন পাবলিশার্স, ঢাকা, পৃ. ৫২) পড়া যাক-
নদীর ছন্দ আছে, ব্যাকরণ নেই। নদীদের সঙ্গে আমি অনেক মিশেছি আর
এইকথা জেনেছি যে তারা কখনও ইশকুলে পড়েনি। এও জানি, তাদের সমাজে
কোনও অধ্যাপক নেই। অতএব প্রশ্নপত্র নেই, পরীাও নেই
নদীকে শাসায় এক অধ্যাপক- ‘ধানমণ্ডি লেকে আমি পিএইচডি করেছি- বিষয়
কবিতা ছিল, অতএব নদীদের ছন্দ শেখাব;
(নদীকে শাসায় এক অধ্যাপক/ আবু হাসান শাহরিয়ার)
শাহরিয়ারের বেশ কিছু কবিতা চমকপ্রদ-চটকদার পঙ্ক্তির সহযোগে রচিত। এমন ধরনের পঙ্ক্তি এ-কবিতায়ও ল করি। ‘নদীর ছন্দ আছে, ব্যাকরণ নেই’ এবং ‘নদীদের ছন্দ শেখাব’- মনে হচ্ছে, নদী ছন্দোময় অথচ ছান্দসিক নয়;- যেন রূপসি নারী জানে না রূপসিত্ব। শাহরিয়ারের এ-কবিতাকে যদি কোনো তরুণ ‘সময়ের কোজাগরি’৫ শিরোনামে নিম্নোক্তভাবে হাজির করে, কী বলার থাকে?
পাড়ভাঙা ইতিহাস কাঁধে ছুটে চলে নদী/ছন্দ আছে যার ব্যাকরণ নেই।
নদীর কাছে গিয়ে যতটুকু জেনেছি/তারা কোন দিন ইশকুলে পড়েনি।
তাদের সমাজে কোন অধ্যাপক নেই/সেহেতু প্রশ্নপত্র ও পরীা নেই
তাই মূল্যায়নে ঝামেলা নেই।
অথচ নদীকে শাসায় এক অধ্যাপক/কিন্তু সপ্তাহান্তে তাকে দেখা যায় ধানমণ্ডি
লেকে মাছ শিকারে ব্যস্ত
(সময়ের কোজাগরি)
‘সময়ের কোজাগরি’ ল করুন, ঐ-‘প্যারাডক্স’র মতোনই মামলা। প্রথম অংশে পূর্ণাঙ্গ নকলের কথা উল্লেখ করলাম। এ-দুটোকেও পূর্ণাঙ্গ নকলের উদাহরণ হিসেবে গ্রহণ করা যায়। আবার কোনো অনুজ যদি নিম্নোক্তভাবে এর ‘পাঠোদ্বার’৬ করে বসে, তখন কাব্যপাঠক ‘বাক্যভয়’র মতোন বানানো কিছু পাচ্ছেন।
নদী ছিলো ভালোছাত্রী। রচনা ছিল ‘বিপন্ন বাংলাদেশ’।
শাসায় এক অধ্যাপক : পড়াবেন ব্যাকরণ : অ-আ-ক-খ…
নেমে আসে রা
এবার অন্য গল্প রা
করতে ফসলের পরম্পরা…
পূর্বসংস্কারে পড়েছিল নদী
সংলাপে বসে এখন জল…
জলময় প্রপাতে ভেসে যাবে আমজনতা।
(পাঠোদ্বার)
এটিও ‘বাক্যভয়’-এর মতো একটু ভিন্নভাবে উপস্থাপিত। এতে তুলে ধরা হয়েছে, মনে হচ্ছে, হয় ‘নদীকে শাসায় এক অধ্যাপক’ না-হয় ‘সময়ের কোজাগরি’র শব্দচিত্রের বাতাবরণে দুঃসময়ের চাকায় পিষ্ট হওয়া আমজনতার সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ।
উপরে তুলে ধরা দুষ্ক্রিয়া একপ্রকার অনুকরণ, তবে এ-অনুকরণ প্লাতো-আরিস্ততলের ‘অনুকরণ’(Imitation/Copy) নয়। প্লাতোর অনুকরণবাদ(Imitation Theory) এই : জাতি আদর্শ(Archetypal), প্রকৃতি তার দৃষ্টান্ত; ললিতকলা(চারুকলা, কাব্য ইত্যাদি) এ-দৃষ্টান্তেরই অনুকরণ। প্লাতোর ‘জাতি’ আধ্যাত্মিক জগতকে নির্দেশ করে। এ-হিসেবে, তার বক্তব্যানুসারে, এ-জাতিই সত্য, জাগতিক বস্তু তার অনুকরণ বলে সত্য নয়; এবং ললিতকলা জাগতিক বস্তুর অনুকরণ বলে সত্য থেকে অনেক দূরে অবস্থিত। অর্থাৎ তাঁর মতে, ললিতকলা হলো নকলের নকল(Copy of copy)। এ-কথা আরিস্ততল সমর্থন করেননি। দৃষ্টান্তবাদেরও এতে সায় নেই। আরিস্ততল প্লাতোর সমালোচনা করে বলেন, বাস্তব জগৎ অন্যকোনও জগতের অনুকরণ নয়(বা নকলের নকল নয়), বরং ললিতকলা তার অনুকারী। তিনি এমন কথাও বলেছেন (যা দৃষ্টান্তবাদ-অসমর্থিত) : ললিতকলায় শিল্পী বস্তুর আদর্শ রূপ বা সঠিক রূপ তুলে ধরতে সচেষ্ট থাকেন (পাশ্চাত্ত্য দর্শনের ইতিহাস, নীরদবরণ চক্রবর্তী)। দৃষ্টান্তবাদ অনুসারে, ফটোগ্রাফিক নয় প্রকৃতির কাল্পনিক-ছবিময় উপস্থাপনই প্রকৃতির অনুকরণ। এবং এ-অনুকরণই শিল্পসৃষ্টির মৌল ব্যাপার। প্রকৃতির বিভিন্ন কিছুর পরিচিতিমূলক নাম (শব্দ) নিয়ে রচিত কবিতাকে প্রকৃতির অনুকরণ বলতে পারি।

হাফিজ রশিদ খানের ‘এই বৈশাখে’(পহেলা বৈশাখ বিশেষ সংখ্যা, ১৪১১, দৈনিক আজকের কাগজ) ও শেরাম নিরঞ্জনের ‘কল্পবেলা’(ফাল্গুন ১৪১১, সমুজ্জ্বল সুবাতাস, সম্পাদক- হাফিজ রশিদ খান ও চৌধুরী বাবুল বড়–য়া) হাজির করা যাক :
এই বৈশাখে নিশ্চয় দেখা হবে তোমায়-আমায়;
আমি বলেছি কাতরকণ্ঠে সমুদ্রের ভাষাবিজ্ঞানীকে
ভাসিয়ে নিয়ো আমাকে ওর চরে
দেয়ালের মতো রূপসী ঢেউয়ে-ঢেউয়ে
রাঙাবালির কাছে
যে-মেয়েটি ঘুমিয়ে-ঘুমিয়ে জেগে থাকে
কৃষিজীবী মা-বাবার ঘরে;
ওদের বাড়ির পাশে পুকুরের জল হবো আমি!
(এই বৈশাখে/হাফিজ রশিদ খান)
এবং
জলেরও চোখ আছে
দেখে শুনে ঘাই মারে কিশোরী বুকে
যুবতী শরীরে লুটোপুটি খায় লম্পট সাগর
আমি চেয়ে থাকি
চেয়ে থাকতে থাকতে থাকতে
ইচ্ছে করে জলের অনুগামী হতে…
(কল্পবেলা/শেরাম নিরঞ্জন)
সমুদ্র, মেয়ে, জল ইত্যাদি শব্দ-শব্দবন্ধের সংযুক্তিতে হাফিজ রশিদ খানের ‘এই বৈশাখে’ নিষ্পন্ন। অন্য কারো কবিতাকে সামনে রেখে তিনি যদি পঙ্ক্তিগুলো নির্মাণ করেন, তবে তার এ-কাজকে দুষ্ক্রিয়াতুল্য অনুকরণ বলা যাবে। এ-কথা শেরাম নিরঞ্জনের ‘কল্পবেলা’-এর বেলায়ও। আর যদি তিনি এই না করে উল্লেখিত বাস্তব ব্যাপারগুলো নিয়ে পঙ্ক্তিগুলো নির্মাণ করেন, তবে তার এ-কাজকে প্রকৃতির অনুকরণ বলা যাবে।
এই পর্বের শেষে বলে রাখা যাক, উপরে যাদের প্রসঙ্গ এসেছে, তাদের মধ্যে কবির চেয়ে কবিযশোপ্রার্থীর সংখ্যা বেশি। এবং বেশিহারে চট্টগ্রামে বসবাসকারী লেখকদের দুষ্ক্রিয়া-বিশ্রীপ্রায় লেখা দেখানো হয়েছে। এটা সম্ভব হয়েছে আমার অবস্থানগত কারণেই। এ-যে অদ্ভুত নির্মাণ প্রতিযোগিতা এটি দেশের বিভিন্ন জায়গায়ও চলছে। কৌশলগত কারণে বা রাহস্যিক দিক রাখার স্বার্থে এ-পর্বে লণীয়ভাবে অন্যান্য জায়গায় বসবাসকারী লেখকের চৌর্যবৃত্তিক-অনুসরণমূখ্য লেখার দালিলিক প্রমাণ তুলে ধরি নি। ভবিষ্যতে গ্রন্থভুক্ত করার সময় তাদের ব্যাপারে বক্তব্য রাখার ইচ্ছে থাকছে। নামোল্লেখ না করে কারো-কারোর বানানো লেখা হাজির করেছি, তা এ-গদ্যের গ্রহণযোগ্যতার স্বার্থেই। তাদের অনেকেরই (‘ঈশ্বর’ ও ‘প্যারাডক্স’ লেখক- দু’জনই ২০০৫, ‘পাঠোদ্বার’ লেখক ২০০৬ এবং ‘বাক্যভয়’ লেখক ২০০৭ সাল থেকে নিয়মিতভাবে লিখছেন) সক্রিয়তার বয়স চলমান দশকের আধুলিভাগ সময়ও নয় (ভবিষ্যতে গদ্যটি গ্রন্থভুক্ত করার সময় তাদের লেখায় অটুট নিজস্বতা খুঁজে পেলে নামোল্লেখ করার ইচ্ছা থাকছে।
কারোর কবিতার অনুকূলে বোধমতো বক্তব্য রাখতে সন্দেহ জাগে, কেনো জাগে তার বয়ান শুরুতে রাখা সত্ত্বেও কোথাও-কোথাও শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ‘কার জন্যে এসেছেন?’, ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন (৭৫, ৮৮, ৮৯ ও ৯২)’, শঙ্খ ঘোষের ‘তুমি’, ময়ুখ চৌধুরীর ‘কথাটা’, ‘মা বলেছেন’,আবু হাসান শাহরিয়ারের ‘অকুলচারীর পাঠ্যসূচি’, ‘নদীকে শাসায় এক অধ্যাপক’, ‘একাকী জীবন হাঁটি আমি আর আমার’ এবং অরণি বসুর ‘বন্ধুর বাড়ি’-এর উপর বক্তব্য দিতে হয়েছে। এটা মূলত বিশ্বাসের উপর নির্ভর করে পাঠকদের কাব্যস্বাদ প্রদানকল্পেই দিতে হয়েছে। চলমান গদ্যের অন্যান্য পর্বে এ-জাতীয় বক্তব্যের আতিশয্য থাকছে।
১পোস্টমডার্ন লীলালাস্য ও বাংলা কবিতা/খোন্দকার আশরাফ হোসেন। ১মনিরুল মনির, ঘরবদলের মানচিত্র, জবান, পৃ. ১৬। ২মনিরুল মনির, ঐ, পৃ. ২৩। ৩রুদ্র শায়ক, সাহিত্য ও সংস্কৃতি, ১৫ জুন ২০০৭, দৈনিক পূর্বকোণ। ৪প্রান্ত পলাশ, সাহিত্য ও সংস্কৃতি, ১৫ আগস্ট, দৈনিক পূর্বকোণ। ৫রুদ্র শায়ক, পুষ্পকরথ, মার্চ ২০০৭, পৃ. ১২০, সম্পাদক- হাফিজ রশিদ খান। ৬হামিদ বিন নাছির, সাহিত্য ও সংস্কৃতি, ১৮ জুলাই ২০০৮, দৈনিক পূর্বকোণ।