পান্ডুলিপি

আন্ডারওয়ার্ল্ড
রাজীব লালন


(রাজীব লালন নতুন কথার সাযুজ্যে কবিতার কাজ সারার পক্ষপাতী। তার কবিতা, সমসাময়িক অন্যান্যের মতো, মুখ্যভাবে ঘটনানির্ভর নয়, শাশ্বতবার্তাবাহী। কবিতায় দ্যোতনাময় শব্দ এবং আনকোরা-দৃশ্যময় শব্দবন্ধ রাখতে পারার পাকামি ইতোমধ্যেই দেখাতে পেরেছেন। শিল্পকর্ম যে একপ্রকার কৌশলীকর্ম, তার জানান তার কবিতায়ও থাকছে।

না বললে নয়, সাম্প্রতিক সময়ে তার কবিতায় ভুলবোঝাবুঝিও স্থান পাচ্ছে। সতীর্থদের সাথে অভিমান করে বিভিন্ন কিসিমের অহমিকাপূর্ণ পরিস্থিতির অবতারণার মধ্য দিয়ে কবিতার দুর্গম পথ পাড়ি দিচ্ছেন। এক্ষেত্রে মনে হচ্ছে কোথাও কোথাও অমূলক ছন্দোবন্ধের আশ্রয় নিচ্ছেন।

রাজীব লালনের ফিরে আসা হোক শাশ্বতবার্তাবাহী কবিতার মূল রাস্তায়। বৃষ্টির সময় পুকুরপাড়ে বসে এ-কালের রুপোর নুপুরপরা-আলতাআঁকা পায়ের কোনো এক ভেলুয়াসুন্দরীর নাচ দেখার মধ্য দিয়ে তার যাওয়া হোক অগ্নিহ্রদে। আমি তার মেধা ও শ্রমের আরো সুচারু প্রয়োগ আশা করছি।

রাজীব লালনের সক্রিয়তা দৈনিক সাহিত্যপাতা ও সাহিত্যকাগজে কবিতাপ্রকাশের মধ্য দিয়ে চলমান দশকের প্রথম পর্যায় থেকেই। তার সাথে আর যাদের আবির্ভাব: সাগর শর্মা, নির্ঝর নৈঃশব্দ্য, মাধব দীপ (তিতীর্ষু দীপ), কাফি কামাল, গোঁসাই পাহ্লভী, আপন মাহমুদ প্রমুখ। সাগর শর্মা ও নির্ঝর নৈঃশব্দ্য শুরু থেকেই অনেকটা নিয়মিতভাবে দৈনিকের সাহিত্যপাতায় কবিতা লিখে যাচ্ছেন। মাধব দীপের যাত্রা অনিয়মিতভাবেই। অপরিপক্কতার দরুন কাফি কামাল ও আপন মাহমুদ এখানকার কোনো দৈনিকের সাহিত্যপাতায় আত্মপ্রকাশ করতে না পেরে ঢাকায় অবস্থান নেন, দৈনিক ভোরের কাগজ ও আজকের কাগজএর সাহিত্যসাময়িকীসম্পাদকের আনুকূল্য/অনুগ্রহ লাভ করেন এবং কয়েকজন সংকলকের/ সম্পাদকের শূন্যদশকী তালিকার কবি হয়ে গেলেন (অথচ শূন্যদশক তখনও চলমান)। গোঁসাই পাহ্লভী নিয়মিতভাবে পত্র-পত্রিকায় গদ্য-পদ্য দুটোই লিখে যাচ্ছেন। এই তাদের পরে, উক্ত দশকের দ্বিতীয় পর্যায় থেকে, সক্রিয় হন যথাক্রমে শেখর দেব (শেখু সখা), হামিদ বিন নাছির, আলী প্রয়াস, স্বরূপ সুপান্থ, মনিরুল মনির, রুদ্র শায়ক, দিদার মালিকী, আসমা বীথি, আজিজ কাজল, ইয়াছিন আরাফাত, প্রান্ত পলাশ, শাহিনুর শায়লা প্রমুখ।

ঢেউএর এ-বিশেষ পর্বে, শুরু থেকে এখন পর্যন্ত স্থ’ূলদাগে সক্রিয় কবি রাজীব লালনের পনেরটি কবিতাকে আন্ডারওয়ার্ল্ড নামে পা-ুলিপি আকারে প্রকাশ করলাম। কবিতাগুলোর বারটি দৈনিক পত্রিকার সাহিত্যসাময়িকী থেকে সংগৃহীত। ‘বৃষ্টি ব্যাখ্যা’, ‘বঙ্গোপসাগরে নাচে আমার সপ্তডিঙ্গা’ ও ‘আমি আর কবিতা’ তার কাছ থেকে সাধারণ কবিতাপর্বে ছাপানোর জন্যে নিয়েছিলাম। নিকট-অগ্রজ বলে যোগ্য অনুজের প্রতি কর্তব্যের অংশ হিসেবে, আমার সক্ষমতা অনুযায়ী, এ-নিভৃতচারী কবির কবিতাপা-ুলিপি প্রকাশ করার কাজটি করে ভুল করেছি বলে মনে করি না।
বলে রাখা আবশ্যক, এ-পা-ুলিপির কোথাও-কোথাও যতিচিহ্ন ও বানানে পরিবর্তন আনা হয়েছে।
)

আন্ডারওয়ার্ল্ড

দৌড়াচ্ছি সৌরঅক্ষে পিংপং বলের মতো লাফিয়ে লাফিয়ে
শাটল ট্রেনের বুক থেকে বটতলির পিঠে বণিক চাঁদ
দাঁড়িয়ে থাকে পাবলিক লাইব্রেরিতে আমায় নিয়ে যাবে নূর ট্রেডার্সে
শাহিদ হাসান আজ বাদশা জাফর হয়ে গেছে!

গোলাপ সিং সুনীল নাথ কবিতার কাগজে কবিরাজি করে
প্রেসক্রিপশান দিলে বেরিয়ে দেখি ডিসি হিল ডাকে
চেরাগি মোড়ে নাকি আন্দরকিল্লা আদিবাসী নৃত্য করে!

দর্শক কোথায়? সবাই তো কবি, সাংবাদিক কবি, কলামিস্ট কবি...
ডানে কবি, বামে কবি; কবির বাঙ্কারে বাতিঘর কাঁধে নিয়ে মার্চ চলে
মেজর সম্পাদক আর এলিট সৈন্যদের
ওদিকে লিটলম্যাগ-সম্পাদক মুহর্মুুহু হুঙ্কার ছাড়ে হাজারো
পদাতিক লিলিপুটদের নিয়ে

এই আন্ডারওয়ার্ল্ড ছেড়ে আমি ঘরে যাব কী করে?

পূর্বকোণ
প্রত্যহ রীতিমতো তারা প্রশ্নের কোঁচ ছুড়ে ছত্রখান করে আমার জলাধার
আমি বর্ণহীন উত্তর হয়ে দক্ষিণ হয়ে শুধু কেঁপে উঠি নগণ্য ক’বার
কতবার রূপকথা হয়ে উড়ে গেছি সবুজের শামিয়ানা- তারা তা জানে না
আমার ভেতর কর্ণফুলি কতবার এগারশ’ হাত খুলেছিল- তারা এটাও জানে না

পুনঃপুনঃ রীতিমতো তারা প্রশ্নে শোলক শোনায়- কবিতা কোথায়?
আমি পুবে উঠে পশ্চিমে নেমেছি, দেখেছি মৌমাছি নাচে সম্পাদকের পাতায়।
আমি নাচি না যাদুকথায় যতটা নাচি মহুয়াদের স্নানের কথায়- তারা তা জানে না
আমার ভেতর রমণীর ছল কতবার আলগা করেছে বুকের বাঁধন- তারা এটাও জানে না

কাগজের কালিন্দিতে পাবে না, পাবে সীতাকুন্ড খুঁজে আমার ভেতর
উত্তরাখন্ডের খোঁজে যেতে পারো পূর্বকোণে পেয়ে যাবে প্রশ্নের শেকড়।

সাঁইজি যিনি গুরুও তিনি

আমার আকাশে লালন আসে দর্শনের পাঠ নিতে
লালন এখন রেনেসাঁর সাঁকো পার হয়ে যায়
সাঁইজি বন্দরে নোঙর ফেলেন
কথার কাঁথায় সবাইকে সেলাই করেন সপ্তরঙে

লালন সব সম্পাদনা করে
লালনের কাছে বাক্যের আষাঢ়, শব্দেরা শ্রাবন হয়ে আসে

সাঁইজি এলেন লালনের দরজায়
এবার তিনি দক্ষিণা চান,
লালন কান্নায় ভাঙে; রক্তাশ্রু ঝরায়,
বুঝলো তিনি সিরাজ সাঁই নন...

আমি লালন পথের পিতা-মাতা
চার বেহারার কাঁধে আমি নাচি না;
আমি চার্বাক চিনি প্রাকৃতর পায়ে আমিই তো পথ

তুমি শুধু সম্পাদিত হও ঋক-সাম-যজু-অথর্বে
ভুলের বিলে থেলিসের জলে
প্লেটো পালাচ্ছে আমাকে ছেড়ে এরিস্টটলকে নিয়ে
জানে তারা আমার রাগ জানে আমার আরব
তুমি জান না সাইমুম সঙ্গে নবী নামে আমার আশায়
হেরার গুহায় খুঁজে তাকে কান্ত তুমি গুরু নও গুরুর ঘুম;
জান না বুদ্ধও সিদ্ধার্থ খুঁজে না
আজ পৃথিবীর পানে আজ কালোপাহাড় আজ অধিক
আজ আরো বেশি লালনা পানে...

তুমি লুকিয়ে একপাশে অগ্নিকোণে
অহং ঝুলিয়েছো ডাঙার পানে অথচ
আমি আছি মাটির দিলে আগুনখোলায়
তুমি দেখ আজ আসমান নামে আমার আসন।

আধুনিকতা... সুচন্দা-ববিতা-চম্পাবতীরা

কী ভীষণ আত্মকেন্দ্রিক হলে কবিতারা সুচন্দা হবে
দুদিকে লালন রেখে মাঝখানে মাইজভান্ডার হবে
কেউ কেন বোঝে না বুকের ভেতরে ঝিলিক-মারা দুপুরগুলো
রাত করে দেয় তারা ভান্ডারি নয়
প্রভাবে ডুবে যারা অভাবে আছে
তো কী হয়েছে- ববিতা উল্টো আমায় বলে, আসলে আঙুলের
আঁচে এখনো তুমি শিল্প শেখোনি, তোমার চোখ শুধূ সুঁচালো হয়
কাঁচুলির কাছে স্তনের বোঁটায়
আমি ডাকি, ভাবতে থাকি চম্পাবতী আর কতো চুমু খেলে কবিতার
সাজে সাজবে না আর ববিতারা- অভান্ডারিদের কান্ডারি হও তুমি।
আমি তো প্রেম বুঝি না, নাভিমূলের নাব্যতা জানি না
ডুবিনি কারো সুবর্ণ মধ্যকে
ডাকতে থাকি, চম্পা! ও চম্পাবতী!
চম্পকনগরে কি আগুন লেগেছে আবার ঐ ঈশান কোণে আগের রঙে
খুব ইচ্ছে আমার আমি ছাড়া আসমুদ্রহিমাচল তোমার অগ্নিহ্রদে ডোবে।
কী ভীষণ আধুনিক হলে কবিতারা তোমাদের রাজনীতি বোঝে!
দুদিকে সাঁইজি ফেলে মাঝখানে ধর্মশালা হবে-
প্লিজ বলো আমাকে!

মেজারমেন্ট
কবিতা কাড়তে-নাড়তে দেরি হয় না আমার
দেরি হয় দেরিদার, ফুকোর ফাঁকিবাজির জন্য
আহা, কবিতা কাজলচোখ
পাঠাতে কেবল দেরি হয়ে যায়
আলাদা আমাকে হতেই হতো
আগে-পরে
শরপুঁটি হেঁটে গেছে সাঁকো ভেঙে ফেনী সদরে
লক্ষ্মীপুরে পুঁটি পুচ্ছ ধরেছে
সাগর-দ্বীপ ছিপ ফেলেছে কুতুবদিয়ায়
বাতিঘরে চোখ মেলেছি আমি
বসুন্ধরার বুকে ঢুকে গেছি কামরাঙা কাচ-চুড়ি ভেঙে চুরমার,
ছুরি চেলেছি কাগজের পেটে।
তবু কবিতা-কৌশল্যা বুকখামে ঢাকতে কেবল ভুল হয়ে যায়...
আগে-পরে আলাদা আমি ছিলাম বটে
সাঁকো ধরিনি বলে যেতে পারিনি আজো
চকবাজারে জেয়ারত করিনি, পারিনি যেতে
কালা মিয়া মুন্সি লেন
ট্রেন মিস করেছি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়, কুমিল্লায়, ঢাকায়, কলকাতায়
কবে যে যাব আর!
কেবলই হেরে যাই কৌটিল্যের কাছে...
আলাদা না হয়ে উপায় ছিল না একেবারেই
মচমচে সকাল, আনচান আকাশ, দুধেল দুপুর, রাতের লবণ খেয়েছি
ভুলেছি অনায়াসে কত পদ্মিনীদের ভুলভুলাইয়া
উন্মাদের মতো ডুব দিয়েছি টেমস্ নদীতে
টোকা দিচ্ছে বুকের বাসরে কর্ণফুলির ফুলস্কেপে
আলোকবর্ষ মাপি।

আমি প্রুফরিডার হতে চাই
বচন আর বাচনের মাঝে আমার বসবাস। আরেব্বাস!
এমন অনুপ্রাস জীবনে দেখি নাই।
স্বীকার করতে শিকার করি যদি, দন্ড দেবে কেন?
হিরাকিটাস কি শুধুই তোমার? পরিবর্তনে আমারও বিশ্বাস।
কল্পচিত্র ও চিত্রকল্পের ব্যবধান খুঁজেছি।
পার্থক্য ততটুকু, যতটুকু
তোমার-আমার আর আমার-তোমার।
অভিধানেও ধান খুঁজেছি। মিলেছে।
খয়রাতে নয়, চাষবাসে। পাশে শেকল ছিল শুয়ে।
বাঁধতে চেয়েছি।
টাইপে ‘ল’-এর স্থলে ‘র’-এ গেছি ভুলে।
দুদিকেই শেকড় আছে জলপানে।
তিন সতীনের ঘরে রূপতত্ত্বের মেকাপ দিলাম আজ।
মাজা ভেঙেছে ধ্বনিতত্ত্ব।
শব্দতত্ত্বের তো পরকিয়ার ব্যারাম।
পাণিণির পায়ে পড়ি বড়ি যদি পাওয়া যায়।
পানি পড়ায় বাকিটুকুও সারা যায় যদি শতরূপার সাড়া পাই!

মেমেসিস
এখন মাসের পর মাস খেয়ে যাচ্ছি বইয়ের মাঠ-ঘাট- পরীক্ষা দেব
পড়ে যাচ্ছি আইনস্টাইন-হকিংস থেকে হোরেস-লুঙ্গিনাস
পাতায়-পাতায় খোদাই করছি আরশিনগর ব্যাবিলন-ইতিহাস।

অথচ বারোমাস চন্ডীদাস থাকি, আড্ডা মারি বেহুলাবাংলায়
মাঝে-মাঝে সম্পাদক সক্রেটিসকে দেখে সিগারেট-মুখে
ঢুকে পড়ি ছন্দের বারান্দায়।
এখন সংশপ্তক সময়- পরীক্ষা দিচ্ছি আজ
পড়া আছে চন্দ্রনাথ সিলেবাস, লিখে যাচ্ছি টনটন
যোগ-বিয়োগের মেঘ- ভরে উঠছে খাতার আকাশ
অথচ আকাশ জুড়ে শুধু নৃত্য করে হাজার-হাজার ছন্দের দাঁড়াশ!

ছোটকাগজে রেনেসাঁ
হাঁটতে-হাঁটতে হঠাৎ তুলেছি গিরিপথ টাইগারপাস
ধুলোর যোনিতে মাতাল হয়ে ছুটেছি বাতাসের ফণা
দেওয়ান হাটে ব্রিজের ঊরুতে আমি রোদ ঘুমিয়ে পড়েছি
ঝুপড়ির পাশে সিঁথি কেটে গেছি ইস্পাতের বাৎসায়ন
হাঁটতে-হাঁটতে এভাবে জব্বর ফুলে উঠেছি বিশ্ববিদ্যালয়ের পথে।

বন্ধু জয়নুলকে দিয়ে করেছি ভবিষ্যতের একটি তকতকে প্রচ্ছদ
আড়াই হাজার কথা সেলাই করেছে আড্ডাবাজ ইলিয়াস
ময়ুখ তো আগেই গেঁথেছে চন্দ্রমল্লিকার একগুচ্ছ মালা
ইউসুফীকে দিয়েছি সাত-আকাশ লালনের টেক্সট
জামালের জন্যও নিয়েছি এক ল্যাবরেটরি নকশিকাঁথা
তের নদী তালপাতা দিয়েছে নজরুলরা।

সাত-সাগরের বিজ্ঞাপনে এবার যাচ্ছি আমি সম্পাদনায়...

অহিংসার পাঠ
বালির বোরাকে আসলো যখন তোমাদের সাইমুম
পাতলে যখন তলোয়ার-তট, ঘোড়ার ঠোকরে
করলে কাতর সবুজের সমতট
বলিনি কিছুই, মেনেছি সাক্ষী শুধু মানতেন মন্দির।

পতাকার পালে কূটনী কুঠিতে আসলো যখন
তোমাদের ভাইকিং, পুঁতলে যখন বারুদের বট
নাবিকের নটে ছিঁড়লে মোহন নদীয়া নগর
বলিনি কিছুই, গৃহমুখে শুধু কেঁদেছি মেলে
মনের মসজিদ।
ভুলিনি কিছুই, ভেঙে যায় বারেবারে বাউল মুকুট।