পুনর্মুদ্রণ

কবিতা ও সাহিত্যকাগজের হালচাল
এখনকার বেশির ভাগ আলোচনায় লক্ষ করছি অব্যাখ্যাত-ফাঁকা মন্তব্যের আতিশয্য। ‘অমুকের কবিতা যুগোত্তীর্ণ’, ‘অমুকের চেয়ে তমুক এগিয়ে’, ‘অমুকের কাগজের কবিতাগুলো মানসম্মত’ ইত্যাদি। অর্থাৎ কেনো অমুকের কবিতা যুগোত্তীর্ণ -অমুক প্রমুখ - অমুকের কাগজের কবিতাগুলো মানসম্মত, তার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ আলোচনায় থাকছেনা। ফলে কবিতা ও সাহিত্যকাগজের প্রকৃত মূল্যায়ন স্থ’লদাগে দুষ্প্রাপ্য থেকে যাচ্ছে। এর জন্যে অজ্ঞ-স্বার্থান্ধ আলোচকদের ধিক্কার না জানিয়ে পারছি না। এ-দ্বয়ের আলোচনায়, তাই, স্বতঃপ্রবৃত্ত সাহিত্যবোদ্ধার নিবিষ্টতা আশা করছি, যার রয়েছে নির্মোহ দৃষ্টিতে অপ্রিয় সত্য প্রকাশ করতে পারার উপচিত সাহস।

পুনর্মুদ্রিত, শাহিনুর শায়লা ও অন্যান্যের আলোচনাত্রয়ে (‘খড়িমাটি এবং চার তরুণের কাব্যাভিযান’/ শাহিনুর শায়লা ও আলি রেজা, ‘কালধারা : শূন্যদশক, আমাদের তৃতীয় চোখ চার তরুণের কবিতায়’/ শাহিনুর শায়লা ও সুমন হায়াৎ এবং ‘ও বোন ঘুড়ি, কেন গেলে চর্যাপদ বনে’/ শাহিনুর শায়লা) কোথাও-কোথাও আপত্তিকর শব্দবন্ধের হাজিরি লক্ষ করি; যেমন, ‘শূন্য দশকের কবি’, ‘কবিযশোপ্রার্থী’, ‘কবিখ্যাতিপ্রিয়’ ইত্যাদি। এ-জাতীয় অজ্ঞানতাপ্রকাশক-শ্রীহীন শব্দবন্ধ উল্লেখ না করেও লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব। অস্পৃশ্য কবিতা সম্পর্কে যে-বক্তব্য, তা যথোপযুক্ত না হলেও সাহিত্যে সদ্গতিপ্রদানকল্পে তাদের সমুচিত-সাহসী এ-পদক্ষেপকে ইতিবাচক দিক থেকে দেখতে হচ্ছে। আলোচনাত্রয়ে সমকালিন কবিতা ও সাহিত্যকাগজের অন্তঃস্থ সমস্যা এবং ভবিষ্যৎ-সম্পাদকদের জন্য জ্ঞাতব্য বিষয়ের উল্লেখ রয়েছে।



আলোচনাত্রয়ের প্রথম প্রকাশ যেহেতু দৈনিক পূর্বকোণে-এর ‘সাহিত্য ও সংস্কৃতি’ পাতায় যথাক্রমে ৯ নবেম্বর ২০০৭, ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০০৮, ১৮ এপ্রিল ২০০৮-এ, সেহেতু এগুলো পাতাটির বিভাগীয় সম্পাদক এজাজ ইউসুফী কর্তৃক সম্পাদিত। এগুলোর কোনো প্রতিক্রিয়া সম্পাদকের হাতে পৌঁছেছে কিনা জানি না। পৌঁছলে সম্পাদক আলোচকের জবাবের আশায় সযতেœ প্রকাশ করতেন। ঢেউ-এর পরবর্তী সংখ্যাগুলোতে, কেবল যাদের কবিতা সম্পর্কে আলোচনাত্রয়ে বক্তব্য রয়েছে, তাদের ছাড়া আর কারোর প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করা হবে না।


কোথাও কোথাও আমার কবিতা সম্পর্কে আলোচকদের উপলব্ধিজাত বক্তব্য রয়েছে। এ-ব্যাপারে আমার কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। নেই এজন্যে যে, আমি জানি, কবিতার যথার্থ ভাব চয়ন করা কোনো পাঠকের পক্ষে সম্ভব নয়। প্রতিক্রিয়াহীন এই জন্যেও, আমার কাজ লিখে যাওয়া আর পাঠকের কাজ তা সম্পর্কে নিজের উপলব্ধি প্রকাশ করা। মনে আছে, মানিও, এক-কেউ আমার কবিতার ভ্রমপূর্ণ ব্যাখ্যা দান করলে অন্য-কেউ তার যথোচিত ব্যাখ্যাও হাজির করতে পারেন।

আমার কবিতার উপর বক্তব্য আছে দেখে আলোচনাত্রয় পুনর্মুদ্রণ করেছিÑ এই বলে কেউ কেউ খামাখা ভ্রু কুঁচকাতে পারেন। ভ্রু কুঁচকান, এতে আমার কিছুই যায় আসে না। আমার জায়গায় আমাকে সৎ থাকলেই হলো। এই হিসেবে বলে রাখা বাহুল্য: যদি আলোচনাত্রয়ের প্রথম প্রকাশ ঢেউ-এর এ-সংখ্যাতেই ঘটতো, তবে অন্যান্যের (যেমন, হাফিজ রশিদ খান, রিজোয়ান মাহমুদ প্রমুখ কবিগণের সম্পাদিত কাগজে এ-জাতীয় স্বার্থজড়িত আলোচনার প্রথম প্রকাশ ঘটেছে) মতো আমাকেও স্বার্থান্ধ বলা যেতো। স্বার্থান্ধ হয়ে নই, এটাও তো খেয়াল করে কেউ কেউ আলোচনাত্রয়ের পুনঃপ্রকাশ করার গুরুত্ব অনুভব করতে পারেন: যাদের সম্পাদনাকে সামনে রেখে আলোচকরা উষ্ণ বক্তব্য রেখেছেন, তারাও এগুলোকে আমলে নিয়েছেন এবং চিহ্নিত অসঙ্গতিগুলো এড়ানোর অভিযানে অনেকাংশে সফল হয়েছেন। উদাহরণস্বরূপ, খড়িমাটি-র পরবর্তী সংখ্যা (ডিসেম্বর ২০০৮) হাজির করা যাক। আগের সংখ্যায় থাকলেও, এ-সংখ্যায় অন্যান্য কাগজ ও বইয়ের স্বার্থসংশ্লিষ্ট-অজ্ঞতাপ্রকাশক আলোচনা নেই, সম্পাদকীয় নোটে কোনো অন্তঃসারশূন্য-ধোঁকাপূর্ণ বক্তব্য নেই এবং উপযুক্ত আগাছাতুল্যকবিতার সন্নিবেশ নেই। বলতে পারি, এ-সংখ্যা ছোটকাগজের চারিত্র্যযুক্ত। এ-জন্যে যে, এতে, দৈনিক পত্রিকার সাহিত্যপাতা যে-আঞ্জাম করবে না, সেরকম একটা আঞ্জামের স্থান রয়েছে। সুমন প্রবাহন বড় মাপের কবি হোন বা না হোন, ছোটকাগজের কাজ তো তাকে নিয়ে মাতামাতি করা। এ-সংখ্যায় তাকে নিয়ে রয়েছে একটি স্মরণমূলক ক্রোড়পত্র। কেবল শঙ্খ ঘোষ কিংবা মোহাম্মদ রফিকের মতোন প্রতিষ্ঠিত কবিদের জন্য ক্ষেত্র‘নির্মাণ করা নয়, তরুণদের জন্যে দিলখোলা হওয়াও তো একজন তরুণ সম্পাদকের উচিত কর্ম। ঘুড়ি-র পরবর্তী সংখ্যাও (ফেব্রুয়ারি ২০০৯) বক্তব্যের সমর্থনে হাজির করা যায়। সম্পাদকীয়-এর প্রথম অনুচ্ছেদ পড়ে মনে হয়েছে, এ-সংখ্যায় ‘সমালোচনা সাহিত্য’ নামে যে-ক্রোড়পত্রটি আমরা পেলাম, তা ‘ও বোন ঘুড়ি, কেন গেলে চর্যাপদ বনে’ জাতীয় গদ্যকে অযথার্থ ভাবার ফলেই। বলতে দ্বিধা নেই, সাহিত্যের এই আবশ্যক শাখা নিয়ে কৃত ক্রোড়পত্রের স্থান হওয়ায় কাগজটি ম্মর্তব্য হলো। আগের সংখ্যায় থাকলেও এ-সংখ্যায় অন্য কাগজের স্বার্থজড়িত-তেলানো আলোচনা নেই, এমনকী কোনো দৈনিক পত্রিকার সাহিত্যপাতাসম্পাদকের লেখাও নেই। কাগজটি যেন ‘দুষ্ট’ চরিত্র ঝেড়ে ফেলে আলোচক-চিহ্নিত নিষ্কলুষ জায়গায় অবস্থান নিতে চাইছে।


খড়িমাটি এবং চার তরুণের কাব্যাভিযান
চট্টগ্রামে লিটল ম্যাগাজিন নামধারী বহু কাগজ বের হয়েছে এবং হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ মধ্যাহ্ন, ঋতপত্র, পরানকথা, ঘুড়ি, ঢেউ, ফলক, পরমায়ু, বেহুলাবাংলা, পুষ্পকরথ, আড্ডারু, জোড়াসাঁকো ইত্যাদির নাম উল্লেখ করা যায়। ‘নামধারী’ শব্দটা যোগ করেছি এই জন্যে যে, এগুলো কোনো দর্শন ধারণ করেনি। কেবল কিছু প্রবন্ধ (নিবন্ধ), গল্প ও কবিতা নিয়ে হাজির হয়েছে এবং হচ্ছে। কোনোকোনোটাতে আবার কাগজ ও বই আলোচনার নামে তোষামোদ ছাপা হয়েছে এবং হচ্ছে। স্মর্তব্য কোনো দর্শন থাকছে না। কিন্তু লিটল ম্যাগাজিনকে হতে হয় চারিত্র্যসমন্বিত, দর্শনবান। নামধারী লিটল ম্যাগাজিনের কাতারে ‘লিরিক’ ও সমুজ্জ্বল সুবাতাসকে রাখা যায় না। মনিরুল মনির সম্পাদিত খড়িমাটি নামধারী লিটল ম্যাগাজিনের শ্রেণিভুক্ত। এ-জাতীয় লিটল ম্যাগাজিন ও দৈনিক পত্রিকার সাহিত্যপাতার মধ্যে তেমন পার্থক্য নেই। কাগজটির জুন ২০০৭ সংখ্যায় শামসুর রাহমান, মীজানুর রহমান ও বিনয় মজুমদারকে নিয়ে যে ক’টা গদ্য রয়েছে, সেগুলো স্মরণমূলক, দৈনিক পত্রিকার দর্শনানুযায়ী। কিছু অনূদিত কবিতা রয়েছে, যেগুলো আজকাল দৈনিক পত্রিকাগুলো হরদম ছাপছে। আকারসর্বস্ব তথা নামধারী লিটল ম্যাগাজিনের মতো এ সংখ্যায় রয়েছে ক’টা গদ্য, গুচ্ছ কবিতা (অকবিতা), কাগজ-বই আলোচনা। লিটল ম্যাগাজিন বলে যে-সব কাগজের (অজ্ঞতাপ্রসূত বা ব্যক্তিরোষ জাহির করা) আলোচনা ছাপা হয়েছে, সেসবের একটাও লিটল ম্যাগাজিন নয়। সবগুলোই বালখিল্যতা। যেগুলোতে সম্পাদকের লেখা রয়েছে, কেবল সেগুলোর (বেশিরভাগের মধ্যে রয়েছে) আলোচনাই ছাপা হয়েছে। এমন কিছু লেখা দেখলাম, যেগুলো খোদ চট্টগ্রামের দৈনিক পূর্বকোণ ও আজাদীও ছাপবে না, কবিতামূল্য দিয়ে ছাপনো হয়েছে। হ্যাঁ, লিটল ম্যাগাজিন তরুণদের তুলে আনে। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, তরুণদের অকবিতা ছাপিয়ে দেওয়া হবে। দেখা গেলো, কোনো তরুণের তিনটি লেখার মধ্যে একটি (মানসম্মত/ মোটামুটি মানসম্মত) কবিতা রয়েছে। সম্পাদক কেবল কবিতাটি ছাপতে পারতেন। সম্পাদক তা করেননি, যা পেয়েছেন তা-ই ছেপেছেন। সম্পাদকত্বহীন সম্পাদকরাই এসব করেন। কথাসাহিত্যিক সৈয়দ ওয়ালী উল্লাহর লালসালুর ‘শস্যের চেয়ে আগাছা বেশি, ধর্মের চেয়ে টুপি বেশি’ চুম্বককথাটি এক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক। ঐ যে দুটি পত্রিকার নাম উল্লেখ করলাম, এগুলো সত্যিকার সাহিত্য করার এজেন্ডা নিয়ে নামেনি। (সত্যিকার সাহিত্য করার সুযোগ এগুলোর নেই) তবু মানসম্মত কবিতা ছাপছে। তাহলে লিটল ম্যাগাজিনের কাজ কী? সম্পাদক কবিতার নামে যে আগাছাতুল্য লেখা ছাপিয়েছেন, তা চারজন তরুণের কবিতার পাঠানুভূতি প্রকাশ করার সময় পরোক্ষভাবে দেখানো হবে।

২.
খড়িমাটির এই সংখ্যার উল্লেখযোগ্য গদ্যকাররা হলেন হেনরী স্বপন, সৈকত দে, তুহিন দাস ও মানস সান্যাল। উল্লেখযোগ্য কবিরা হলেন শাহিদ আনোয়ার, হাফিজ রশিদ খান, আবদেল মাননান, রুদ্র অনির্বাণ, সবুজ তাপস, কাজী নাসির মামুন, তুষার কবির, মাদল হাসান, ফেরদৌস মাহমুদ, নিতুপূর্ণা, গৌতম কৈরী, পিয়াস মজিদ, অরূপ কিষাণ, কামাল মুহাম্মদ, স্রূপ সুপান্থ, লায়লা ফেরদৌস ইতু, কাজী জিন্নুর, সজল ছত্রী প্রমুখ। মলয় রায়চৌধুরীর ‘কবিতার কাজ, কাজের কবিতা’ শিরোনামের একটি মুক্তগদ্য ছাপা হয়েছে। পুনর্মুদ্রণ করা হয়েছে উৎপল ভট্টাচার্য সম্পাদিত কবিতীর্থর সেপ্টেম্বর ১৯৮৯, ১৮ তম সংখ্যা থেকে। এক্ষেত্রে সম্পাদকের মুসাবিধা উল্লেখ্য: ‘আমরা নতুন অসঙ্গতি কিংবা গদ্যের নামে আবর্জনা না বাড়িয়ে পুরানো অথচ মজবুত কথার পুনর্পাঠে বিশ্বাসী, যা সুদূরগামী কবিতার কাছে নিয়ে যাবে।’ মলয় রায়চৌধুরীর দৃষ্টিতে, কাজের কাজ বা ফাংশনাল হয়ে ওঠাটাই হল একটা কবিতার সদগুণ। এ-জাতীয় কবিতা সামাজিক দায়বোধ থেকে রচিত হয়। ব্যাপারটা না বুঝে বেশিরভাগ সম্পাদক বাজে রকম ফন্দি আঁটেন। তাঁর মতে, যা সমাজের কাজে আসে না, তা টনক নড়াতে পারে না। আর যা টনক নড়াতে পারে না, তা কবিতা না হয়ে অন্যকিছু হোক। গদ্যটি খুবই ভাব্য। তবে ‘শিল্পের জন্য শিল্প’ তত্ত্ব দিয়ে একে তুলোধুনো করা যায়। সম্পাদক মুসাবিধায় উল্লেখ করেছেন,  মলয় রায়চৌধুরীর এই গদ্যে সমকালীন কবি ও কবিতার নানা অনুষঙ্গ রয়েছে। কিন্তু আমরা এতে এমন কিছ খুঁজে পাইনি। এটাকে সম্পাদকের মূর্খতা বলব। না পড়ে নোট দেওয়া উচিত হয়নি।
৩.
এবার চারজন তরুণের কবিতার পাঠানুভূতি প্রকাশ করবো। এতে পরোক্ষভাবে সম্পাদকের খামখেয়ালিপনা তুলে ধরব। তরুণরা হলেন সবুজ তাপস, নিতুপূর্ণা, ফেরদৌস মাহমুদ ও অরূপ কিষাণ।
কোনো একটা কিছুকে অবলম্বন করে বা কোনো কিছুকে পাওয়ার আশায় মানুষ বেঁচে থাকতে চায়। যার কোনো চাওয়া নেই, সে মানুষ নয়, দেবতাও নয়, ঈশ্বরও নয়। অভাবের ভেতরেই চাওয়ার ব্যাপারটা নিহিত। ঈশ্বরের অভাব (যদিও বলা হয়, ঈশ্বর অভাবমুক্ত) হল মানুষের পূজা বা আরাধনা প্রাপ্তি। শূন্য দশকের অন্যতম আলোচিত কবি সবুজ তাপস ‘দোটানা ও টানা’ কবিতার ‘দোটানা‘ অংশে সাবলীল ভাষায় চিত্তাকর্ষী পরিস্থিতি দাঁড় করে তার বেঁচে থাকার কারণ তুলে ধরেছেন। যখন তিনি দেখতে পান হানাহানিপূর্ণ কাজকারবার, বৈষয়িক-সাংসারিক দরকষাকষি, মানুষের চালাকিপূর্ণ আচরণ, আত্মহত্যা করবার ইচ্ছা পোষণ করেন, ঠিক তখনই রাস্তায় বের হয়ে যদি কোনো সুন্দর-সোমত্ত নারীর দর্শন পান, ভাবেন বেঁচে থাকা জরুরি। অর্থাৎ জৈবনিক জটিলতা তাকে আত্মহত্যাপ্রবণ করে তোলে এবং পাশাপাশি সোমত্ত নারীর সৌন্দর্য করে তোলে বাঁচনপ্রিয়। কবি এখানে ‘দোটানা’ দ্বারা বোঝাতে চেয়েছেন, তার মধ্যে আত্মহত্যা ও বেঁচে থাকার মতোন দু’বৈপরিত্যের দ্বন্ধ চলছে এবং বরাবরই বেঁচে থাকছেন। এই অংশে ‘জৈবনিক জটিলতা’ ও ভাবের ভাইব্রেশন’ এর মতোন, তার নিজস্ব, আনুপ্রাসিক ব্যবহার রয়েছে। ‘টানা’ অংশ খুবই হৃদয়স্পর্শী।
আমাকে দু’হাতে টেনে নাও
বুকের ভেতর,
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ফার্নিচার হাতে
যেমন টেনে নাও
চোখের তলে
কাজলের নৌকোচাঁদ।
পাঠক এমন সহজ-সরল ভাষার আবেদনময় কবিতাই চান। ‘কাজলের নৌকোচাঁদ’ দৃশ্যকাব্যময় ও শিল্পসম্মত। যেকোনো পাঠক বলতে বাধ্য হবেন, ‘দোটানা ও টানা’ পুরোটাই নতুন কথার কাব্যানুষঙ্গ।

‘স্বীকারোক্তি’ কবিতার শ্রুতিসুন্দর পঙক্তিÑ
পাশে ডিসিহিল আর আশীষ সেন: সবকিছু ভুয়া
সত্য কেবল অরুণ দাশগুপ্ত,
জ্যোতির্ময়, জ্যোতির্ময়। 
আর গতিসম্পন্ন পঙক্তিÑ
তোমরাও দেখ, নন্দন কানন-জামাল খাঁ আর মোমিন রোড দৌড়ে এসে একসাথে ঢুকে পড়ে চোখে, মুখের ভেতর
এই কবিতায় কবি কর্ণফুলির মতোন কতকগুলো অনুষঙ্গ তুলে ধরে বলেছেন, তিনি কোন কবি নন, কবি হল অনুষঙ্গগুলোই। এগুলো তার হাত-পা দখলে রেখে কবিতা লিখে নেয়। এটা এক ধরনের আবেগের কথা। কবিতাতো আবেগের হাত ধরে হাঁটে। অনুষঙ্গগুলোকে যদি প্রকৃতি বা পবিবেশ হিসেবে ধরি, তবে বলা যায় এখানে সবুজ তাপস নিজেকে প্রকৃতির কলম হিসেবে তুলে ধরেছেন। তিনি হয়তো বুঝিয়েছেন, কর্ণফুলিরা তাকে প্রলুব্ধ করলে কাগজ-কলম টানেন এবং কবিতা লেখা হয়। তো এর ক্রেডিট কর্ণফুলিদেরই। কেননা তারা তাকে প্রলুব্ধ না করলে কবিতার জন্ম হতো না। অর্থাৎ যা ভাব জাগায় তা-ই আসল। এ-জাতীয় কাব্যদর্শন কারো কারো মনপূত না হলেও নতুন কিছু। প্রাসঙ্গিক বক্তব্য যে, এই কবিতায় যতি চিহ্নের ব্যবহার উপযুক্তভাবে নেই। যেমন, ‘জ্যোতির্ময়, জ্যোতির্ময়’-এর পর ‘।’ (দাঁড়ি) চিহ্ন থাকার কথা, কিন্তু ‘!’ (আশ্চর্যবোধক) চিহ্ন ব্যবহার করা হয়েছে। একটু আগে উল্লেখ করেছি, কবিতা আবেগের হাত ধরে হাঁটে। এর অর্থ এই নয় যে, এই আবেগের কোনো ৗেক্তিকতা থাকবে না। কবিতায় থাকবে কবির যৌক্তিক আবেগ। এই আবেগ রিয়েলিস্টিক। অদৃশ্য বস্তু সম্পর্কে যে আবেগ তা রিয়েলিস্টিক নয়, যৌক্তিকতাবর্জিত। তরুণ কবি ফেরদৌস মাহমুদের ‘দৈব, বিশ্বাস ও ধ্যান’ এমন এক ধরনের লেখা যা বস্তুধর্ম তথা যৌক্তিকতাবর্জিত। তিনি প্রথমেই উল্লেখ করেছেন, পৃথিবী নাকি দৈবের চিড়িয়াখানা। মধ্যযুগমনস্ক তথা ‘সীমা লঙ্ঘন করো না’ বিশ্বাসীরা এমন বলতে পারেন। কিন্তু আধুনিক পাঠক এ-সময়ের কোন তরুণের কাছে এজাতীয় বক্তব্যের কোনো কবিতা আশা করেন না। বলা হয়েছে, তিনি নাকফুল বানানোর কৌশল শিখেছেন বানরের কাছে। তা তিনি লিখে রেখেছেন জলডাঙার প্রাচীন দলিলগুলোতে। সূর্যোদয়ের দেশ বলতে আমরা জাপানকেই জানি। তিনি উল্লেখ করেছেন, ভিক্ষার থালায় ফুল বিক্রি করতেন, জাপানি নাবিকেরা কয়েনের বিনিময়ে তা কিনে নিতো, দিয়ে যেতো ভিন্ন সৌরজগতের অভিন্ন সামুদ্রিক পাথর। ব্যাপারটা উদ্ভট ধরনের মনে হয়েছে। এটাকে কবিতার নামে তার প্রলাপ বকাই বলব। তবে এটা উপলব্ধ হল যে, তিনি দেশাত্মবোধ থেকে ভ্রমাত্মক তথ্যসম্বলিত লেখাটি লিখেছেন। ‘এক থালা লিচু’তে কবিতার নামে মদোন্মক্ততা প্রকাশ করা হয়েছে। তিনি মদমাতাল হলেন, সম্ভবত প্রিয়াও। তা না হলে বলতে পারেন না, রাতের বেলায় ‘আকাশ গাঢ়ো নীল..., চাঁদ উঠেছে...।’ মদমত্ততা নিয়ে ভালো কবিতা হতে পারে। এটা তেমন ধরনের কিছু নয়। আমরা যখন শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার ভেতর ডুব দিই, তখন দেখতে পাই মদোন্মক্ততা কীরূপে কবিতা হয়েছে।
এ সময়ের বেশির ভাগ তরুণ কবিতার নামে দুর্বোধ্য কথার চাষাবাদ করছেন। অথচ দেশের প্রধানতম কবি নির্মলেন্দু গুণ ও সৈয়দ শামসুল হকের কবিতাও বোধ করা যায়। পাঠক কবিতার ভেতর ঢুকতে না পারলে, কবিতার ভবিষ্যৎ...। তরুণদের কবিতা দুর্বোধ্য হওয়ার পেছনে পদ ও পঙক্তির ভ্রমাত্মক ব্যবহারকে দায়ী করা যায়। নিতুপূর্ণার ‘পাখির উঠোন হতেও পারে বধ্যভূমি’ কম বাক্যের লেখাটিতে পদের ভ্রমাত্মক ব্যবহার বেশি। প্রথম বাক্যটি ‘লাগে’ পদের জন্য শ্রুতিকটু। দ্বিতীয় বাক্যে ‘ঝাঁ ঝাঁ বৃষ্টি’ ভ্রমাত্মক। কেননা বৃষ্টির ক্ষেত্রে ‘ঝাঁ ঝাঁ’ অনুপযুক্ত, ‘ঝাঁ ঝাঁ’ অব্যয় পদ। পদের দিক থেকেও এটি ভুলভাবে প্রযুক্ত। এটি এমন ধরনের পদ, যা প্রচন্ড উত্তাপের ভাবব্যঞ্জক, যন্ত্রণার ভাবপ্রকাশক, নিস্তব্ধতার ভাবদ্যোতক, অতিক্ষিপ্রতাপ্রকাশক। এর কয়েকটি ব্যবহার: ‘রোধে ঝাঁ ঝাঁ করা’, ‘মাথা ‘ঝাঁ ঝাঁ’ করা’, রাত ‘ঝাঁ ঝাঁ’ করা ও ‘ঝাঁ ঝাঁ’ করে কাজ করা। তাছাড়া এর ‘এদেশ এখন শিকারি/ হত্যা ও খুনি/ নানান রকম শোকের বাতি’ ভ্রমাত্মক। ‘শিকারি হত্যা ও খুনি’-এর মধ্যে ভুলটা আবিষ্কার করা যাবে। নিতুপূর্ণার ‘লটারি ও টিকিটির মতো যাপন-০২’-তে গভীরবোধের কিছু নেই। দুটোতে যতিচিহ্নের ব্যবহার নেই, যার ফলে কোনো কোনো লাইনকে অদ্ভুত দেখাচ্ছে। প্রথমটির ‘যে সব অঞ্চলে আহত পাখিরা উড়ে গেছে উপদ্রুত ভাবতে পার তাদের’ লাইনটি অপ্রয়োজনীয়। তাছাড়া আহত পাখির ব্যাপারটা প্রাসঙ্গিকভাবে আসেনি। দ্বিতীয়টির ‘সময়কে মনে হয় হঠাৎ-ই বাক্সময় করতোয়া’ বক্তব্যে নতুনত্ব নেই। কেননা সময়কে স্রোত কিংবা নদীজলের সাথে তুলনা করার ব্যাপারটা অনেক আগের। এর ভাবরস একটি গদ্যময় বাক্যে নিহিত: জাগতিক ঘটনা যেমন আমাদের প্রেম জিঘাংসা-শুশ্রুষা ও কাব্য প্রকৃতির অন্যথা নয়’।  

কালধারা: শূন্যদশক, আমাদের তৃতীয় চোখ চার তরুণের কবিতায়
মূলত চলমান শূন্যদশকের কবিদের কবিতার শিল্পস্বাদ লাভের জন্যই আমরা কাগজ আলোচনায় মন দিয়েছি। ইতোপূর্বে খড়িমাটি আলোচনায় এর জানান দিয়েছি। আমাদের প্রতিটি লেখায় চট্টগ্রামে বসবাসকারী বা চট্টগ্রামের পত্র-পত্রিকায় যাদের উপস্থিতি অতিমাত্রায় পেয়েছি যাদের কবিতা বা কবিতাগ্রন্থ ২০০০ সালের আগে প্রকাশিত হয়নি, কেবল তাদের কবিতার মূল্যায়নধর্মী অভিমত প্রাধান্য দেব। এই জন্যে যে, একবিংশ শতাব্দির এই তাদের কারো কারো কবিতায় চমকসৃষ্টিকারী মেজাজ লক্ষ করছি। তাছাড়া তাদের কাছে আমাদের প্রত্যাশাও অনেক। এই হিসেবে আমরা সবুজ তাপস, ফুয়াদ হাসান, মংসিংঞো, নির্ঝর নৈঃশব্দ্য, থোঙাম সন্জয়, নাজমুল হুদা, সাগর শর্মা, আলী প্রয়াস, আলম সৈয়দ, রাজীব লালন, মধাব দীপ প্রমুখ কবিগণকে বেছে নিয়েছি। এই লেখায় কালধারা ও তৃতীয় চোখ আলোচনা এবং এই দুটো কাগজ থেকে নেয়া এই তাদের কয়েকজনের কবিতার চয়িতভাব তুলে ধরব।
শুরুতে কাগজদুটো সম্পর্কে যৎসামান্য বলে রাখি। তৃতীয় চোখ আলী প্রয়াসের সম্পাদনা। এর তৃতীয় সংখ্যা প্রকাশিত হয় ফেব্রুয়ারি ২০০৭-এ। কালধারার ‘কবিতা ২০০৬ সংখ্যা’ আকাশ মাহমুদ ও একেএম গোলাম ফেরদৌস সম্পাদিত। সংখ্যাটি প্রকাশিত হয় জুন ২০০৭-এ। সংখ্যাটিতে যাদের কবিতা ছাপা হয়েছে তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন: আকতার হোসাইন, আবু মুসা চৌধুরী, আসাদ মান্নান, ইউসুফ মুহম্মদ, এজাজ ইউসুফী, কিশওয়ার ইবনে দিলওয়ার, চন্দন চৌধুরী, জিয়া হায়দার, দিলওয়ার, নাজিমুদ্দীন শ্যামল, নিতাই সেন, নীলাঞ্জন বিদ্যুৎ, ফাউজুল কবির, ফুয়াদ হাসান, বিনয় সরকার, বিশ্বজিৎ চৌধুরী, মুজিবুল হক কবীর, মতিন বৈরাগী, মালা মাহবুব, মুশরিক হোসাইন, রিজোয়ান মাহমুদ, শামীম রেজা, শাহাবুদ্দীন নাগরী, শাহিদ আনোয়ার, শিহাব সরকার, শেলী নাজ, সবুজ তাপস, সাখাওয়াত টিপু, সাজিদুল হক, সিদ্ধার্থ শংকর ধর, সেলিনা শেলী, স্বপন দত্ত, হাফিজ রশিদ খান ও হোসাইন কবির। আর তৃতীয় চোখর এই সংখ্যার উল্লেখযোগ্য কবিরা হলেন: আদিত্য অন্তর, আমীর খসরু স্বপন, আলম সৈয়দ, আলী প্রয়াস, আসিফ নূর, ক্যামেলিয়া, খালেদ মাহবুব মোর্শেদ, চন্দন চৌধুরী, নির্ঝর নৈঃশব্দ্য, নুপা আলম, বিনয় সরকার, ম. রহমান মফিজ, মোক্তার আমদ রাশেদ, য়ানসার হক, শাহেদ সাদ উল্লাহ, সঞ্জীব পুরোহিত, সবুজ তাপস, সিরাজুল হক সিরাজ ও হাফিজ রশিদ খান।
এবার কথামতো, আমরা ফুয়াদ হাসানের ‘কৃতজ্ঞতা স্বীকার’, সবুজ তাপসের ‘উৎসর্গ: ময়ুখ চৌধুরী’ এবং ‘সামুদ্র সংলাপ’; চট্টগ্রামের বাইরে বসবাসকারী দু’জন তরুণের কবিতা- বিনয় সরকারের ‘কালোরাত কাতরায়’, ‘পূজাঞ্জলি’, বিষাদ বচন’ ও সিদ্ধার্থ শংকর ধরের ‘ভাড়া করা বাড়িতে বেশিদিন থাকা হয় না’-এর চয়িতভাব-দৃষ্ট সমস্যা তুলে ধরছি।
শূন্য দশকের অন্যতম প্রধান আলোচিত তরুণ কবি সবুজ তাপসের কবিতা সরল এবং গভীরবোধবহ। উল্লেখিত কবিতাদুটো (‘উৎসর্গ: ময়ুখ চৌধুরী’ ও ‘সামুদ্র সংলাপ’) পড়লেও এর প্রমাণ পাওয়া যায়। কালধারায় প্রকাশিত তার ‘উৎসর্গ: ময়ুখ চৌধুরী’ কবিতার মূল কথা: মানুষের স্বভাব এমনই, সে বিভিন্ন উপায়ে অপরের কাছে যাবে এবং অপরকে বুঝাতে চা’বে। এর অর্থ- সে অপরকে বোকা মনে করে। অপরকে বোকা মনে করার এই যে-দর্শন, ইতোপূর্বের কোনো কবিতায় পরিলক্ষিত হয় না। কবিতাটির শিরোনামও ব্যতিক্রান্ত। কবিতার শিরোনামও যে এই রকম হতে পারে, তা সবুজ তাপসের কাছে শিখতে পেরেছি। প্রশ্ন হতে পারে, কেনো এই শিরোনাম। অনুমান করতে পারি, এই কবিতায় তিনি কবি ময়ুখ চৌধুরীর আচরণ মাথায় রেখে মানুষের শাশ্বত স্বভাব তুলে ধরতে গেছেন। এই কবিতার ‘বিচিত্র চিত্র’, ‘কথার খই’, ‘ঈশ্বরের বাড়ি’, ‘বে-আন্দাজ কাজ’, ‘ভাবনার বৃষ্টিপাত’, ‘তর্ক-বিতর্কের ধোঁয়া’, ‘কথার কাঁথা’ ও ‘সবুজ অবুঝ’ খুবই দৃশ্যমান শব্দবন্ধ। এগুলোর কোনোকোনোটিতে আনুপ্রাসিক বুনন পরিলক্ষিত। এই যে আনুপ্রাসিক বুনন ও দৃশ্যময়তা, কবিতাটিকে ঝকঝকে করেছে। তৃতীয় চোখ এ প্রকাশিত তার ‘সামুদ্র সংলাপ’ কবিতাটি শ্রুতিসুখকরও। সমুদ্র দেখে আসতে তাকে কেউ একজন (হয়তো বন্ধু) সাথে নিয়ে যেতে চেয়েছিলো। তিনি এতে অসম্মতি প্রকাশ করেন। তাকে জানালেন, নারীর প্রতারণায় তার কবি হয়ে ওঠা। সমুদ্র দেখতে গেলে যদি সমুদ্রও তাকে প্রতারিত করে, অগস্ত্যযাত্রার পথ রচিত হতে পারে। সমুদ্র তার সাথে প্রতারণা করতে পারে। কারণ তিনি দেখান, নারীর মতো এটিও খোঁজে চাঁদের হাসি, অমাবস্যার দাসী এবং ভাসায়-ডোবায়। বলতে পারি, আর প্রতারিত হতে না চাওয়ার মানসিকতা থেকেই তার এই অসম্মতি প্রকাশ। আবার যদি নারীর কাছে গিয়ে কবি হওয়া আর সমুদ্রের কাছে গেলে মৃতবস্তু হওয়াকে বিবেচনা করি, তবে নারী ও সমুদ্র এবং কবি হওয়া ও মৃতবস্তু হওয়া Ñ দুটি সমরৈখিক শ্রেণি দাঁড় হয়। সবুজ তাপস নারী ও সমুদ্রের চরিত্র একই সীমারেখায় রেখেছেন। কবি হওয়া আর মৃতবস্তু হওয়াকে একই কিছু বলার পক্ষে যুক্তিও রয়েছে। যুক্তি এই: কবি হওয়া আর সাধারণ মানুষ থাকা এক কথা নয় এবং কবি হওয়াতো সাধারণ মানুষ থেকে রূপান্তরিত কিছু হয়ে যাওয়া। সবুজ তাপস কবি হতে চাননি। তার ভাষায়:
অথচ আমার কবিতা লেখার
ইচ্ছে ছিল না
এভাবে, সমুদ্রের কাছে গিয়ে প্রতারিত হয়ে মৃতবস্তু হতেও তার ইচ্ছে নেই। তার ভাষায়:
তার কাছে যেতে চেয়েছো তো তুমি যাও নিজে
পতেঙ্গার বিচে
আমি যাব না
সে যা-ই হোক, কবিতাটির বিন্যাস খুবই শিল্পিত।
দ্যাখো, যত নারীর কাছে গেলাম, সবাই বিমুখ
হৃদয়ে ছেড়ে দিলো অসুখ,
নিবের চুচুক
থেকে প্রতিরাতে কালি ঝরে,
অথচ আমার কবিতা লেখার
ইচ্ছে ছিল না
না বললে নয়, সবুজ তাপস সমুদ্রকে নারীর উপমান হিসেবে দেখেছেন। এই দেখাতে নতুনত্ব নেই। কারণ, ইতোপূর্বে কোনো কোনো কবি নারীকে নদীর উপমায় উপস্থাপন করেছেন। নদী আর সমুদ্র এক না হলেও বৈশিষ্ট্যগত দিক থেকে খুব কাছাকাছি।
শূন্য দশকের অন্যতম কবি ফুয়াদ হাসানের কবিতা সরল এবং চটুল ঢঙের। তার বেশির ভাগ কবিতা ক্ষীণকায়। কিন্তু কালধারায় প্রকাশিত ‘কৃতজ্ঞতা স্বীকার’ দীর্ঘকায় এবং বর্ণনামূলক। অথচ এ-সময়ের কবিতায় বর্ণনা তথা বিবৃতি পরিহৃত। এ-কবিতায় তিনি তার বন্ধুদের স্বভাব, অবস্থা, কাজ ইত্যাদি তুলে ধরে বলেছেন, আমার বন্ধুরা আমাকে যথেষ্ট ভালোবাসে। তিনি বলতে চেয়েছেন, তাকে নিয়ে বন্ধুদের এই যে স্বভাব বা আচরণ, তা তাকে ভালোবাসার কারণেই। বন্ধুত্ব থাকার কারণেই তারা তার, তার কবিতা সম্পর্কে ইতি-নেতিবাচক মন্তব্য করেছেন। তিনিও তাদের সম্পর্কে - তাদের কবিতা সম্পর্কে মন্তব্য করতে চান। তার ভাষায়, ‘আমিও আমার বন্ধুদের মতো হতে চাই’। এটা এক ধরনের বক্রোক্তি। কবিতা এখানেই। না বললে নয়, বন্ধুদের কবিতা সম্পর্কে মন্তব্যপ্রবণ হতে চাওয়া বিষয়ক কবিতাটির জন্য প্রথম স্তবক অপ্রয়োজনীয়। কেবল দ্বিতীয় স্তবক উল্লেক করেও কাজটা নিষ্পন্ন করা যেতো। এই কবিতার কোথাও কোথাও যতি চিহ্নের ব্যবহার নেই, ফলে শ্রুতিকটু লাগবে পাঠকের কাছে। যেমন, ‘সরকারি মন্দলোক ভিড়লে আঁচলে আদিবাসী ক্যাকটাস সাজে প্রয়োজনে নিতান্ত বাঘারু...’। তাছাড়া ‘আমার বন্ধুরা মৃত পিঁপড়ের বিরহে কাতর’ ভ্রমাত্মক। কারণ, যা মৃত, তার বিরহ থাকতেই পারে না।

ও বোন ঘুড়ি, কেন গেলে চর্যাপদ বনে
বর্তমানে সমালোচনা সাহিত্যিক নেই বললেই চলে। অনেকেই সমালোচনা করতে জানেন না। সমালোচনার নামে লিখেনÑ অমুকের লেখা পড়ে মজে গেছি, অতিরিক্ত লেখা পড়া সুযোগ পেতে চাই। কেনো মজে গেছেন, কেনো অতিরিক্ত চান Ñ ব্যাখ্যা দেন না। অনেকেই জানলেও সাহসের অভাবে বা ভয়ে একাজে অগ্রসর হন না। ভয় করেন এই জন্যে যে, অমুকের শত্রু হতে চান না; তাছাড়া এখনকার বেশির ভাগ লেখক অসহিষ্ণু, ফলে অপ্রত্যাশিত ঝগড়া সৃষ্টি হতে পারে। শতবর্ষে বুদ্ধদেব বসু। বুদ্ধদেব বসু, নমস্কার। নির্ভয়ে ইতোপূর্বে কয়েকটা কাগজের-কাগজস্থিত কবিতার সমালোচনাধর্মী মূল্যায়ন করেছি। এজন্যে, কেউ কেউ যে কোপিত হননি, বিশ্বাস করি না। সবারে বলি, বিক্ষোভ নয় সাহিত্যিক প্রক্ষোভ দরকার; এবং এই প্রত্যাশায় এই কাজে হাত দিয়েছি।
বলে রাখা আবশ্যক যে, ‘সাহিত্য ও সংস্কুতি’ (দৈনিক পূর্বকোণ), ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০০৮-এ প্রকাশিত ‘ কালধারা: শূন্যদশক, আমাদের তৃতীয় চোখ চার তরুণের কবিতায়’ প্রতিক্রিয়ামূলক গদ্যে চট্টগ্রামে বসবাসকারী তরুণ কবিদের শূন্যদশকী তালিকা তুলে ধরেছি। নির্ঝর নৈঃশব্দ্য সেই তালিকার একজন কবি। কথামতো, ঘুড়ির চতুর্থ সংখ্যার আলোচনায় শূন্য দশকের কবি সোহেল হাসান গালিবের সাথে তার কবিতার এবং নিব্বই দশকে লিখতে আসা কবিখ্যাতিপ্রিয় দুই তরুণ- রেজাউল করিম সুমন ও আহমেদ মুনিরের লেখার অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ রাখতে যাচ্ছি। এবং পরোক্ষভাবে একজন সম্পাদকের কবিতা বাছাইয়ের বেলায় কোনগুলো অযোগ্যতা, সম্পাদনার উদ্দেশ্য কি নয়- দেখানোর চেষ্টা করছি।

শুরুতেই গতানুগতিক কাজটা সারি। ‘শিল্পসাহিত্য ও চিন্তার ছোটকাগজ’ শ্লোগানবাহী ঘুড়ির, সম্পাদক আসমা বীথি, চতুর্থ সংখ্যা বেরিয়েছে ফেব্রুয়ারি ২০০৮-এ। এই সংখ্যার উল্লেখযোগ্য কবিরা হলেন চঞ্চল আশরাফ, মুজিব মেহদী, পুলক পাল, শামীম রেজা, মোস্তাক আহমাদ দীন, বায়তুল্লাহ কাদেরী, ইয়াসমিন গুণরতেœ, লাকদাসা বিক্রমাসিনহা, সিরি গুণাসিঙ্গে, আর মুরুগাইয়ান, ফুয়াদ হাসান, সোহেল হাসান গালিব, নির্ঝর নৈঃশব্দ্য, মুয়িন পার্ভেজ, চন্দন চৌধুরী, নায়েম লিটু, রুদ্র অনির্বাণ, লুবনা চর্যা, পিয়াস মজিদ, অলক চক্রবর্তী, আবু নঈম মাহতাব মোর্শেদ ও প্রান্ত পলাশ। উল্লেখযোগ্য গদ্যকাররা হলেন জাকির তালুকদার, আলফ্রেড খোকন, সুস্মিতা চক্রবর্তী, শুভাশিষ সিনহা, উম্মে মুসলিমা ও সাইদুল ইসলাম। এবং উল্লেখযোগ্য গল্পকাররা হলেন পাভেল পার্থ, জয়দীপ দে, পূণ্যকান্তে বিজেনায়েকে, কে. সাদ্দানাথান, কে. কে. সামানকুমারা, রমেশ গুনেসেকারা ও এন. এস. এম. রামাইয়া।

কথামতো শুরু করা যাক। সোহেল হাসান গালিবের ‘ক্রীতদাসের হাসি’-এর প্রথম স্তবক পঙ্ক্তিবহুল। এতে আরব্য রজনীর গল্পের দৈত্যের যে বর্ণনা দেযা হয়েছে, তা একটি মাত্র মজবুত পঙ্ক্তির মাধ্যমে তুলে ধরা যেতো। ‘জোছনার সরণি’র কারণে দ্বিতীয় স্তবকের ‘তারা সব জোছনার সরণির পাশে এসে দাঁড়িয়েছে নতজানু’ মনের মধ্যে কোনো দৃশ্য হাজির করে না। চতুর্থ স্তবকের ‘অচিরাৎ’ ও ‘খিন্ন’ বহুলাংশে সেকেলে শব্দ। অথচ এগুলোর বর্তমান ও বোধ্য ব্যবহার বর্তমান (‘অচিরাৎ’ মানে ‘অচিরে’ এবং ‘খিন্ন’ মানে ‘অবসন্ন’, ‘কান্ত’, ‘দুঃখিত’ ইত্যাদি। অপরিচিত শব্দ হওয়ার কারণে, পাঠক নয়- অনেক কবিকেও অভিধানের দ্বারস্থ হতে হবে। কবিতা বোধ করা আর বোধ করতে এসে শব্দাবদ্ধ হওয়া এক কথা নয়। প্রথম শব্দটি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত ব্যবহার করেছেন এভাবে: ‘উন্মাদনা অচিরাৎ পলাল কোথায়?’ দ্বিতীয়টির ব্যবহার কাজী নজরুল ইসলাম করেছেন এভাবে: ‘খিন্ন মলিন তনুলতা’ এবং কাজী আবদুল ওদুদ করেছেন এভাবে: ‘খিন্ন জীবনখানি একটু সুস্থ’। ‘কিম্ভুত ও কিমাকার’-এর জন্যেই শেষ স্তবকের ‘তবু সত্য, আমি কিম্ভুত ও কিমাকার’ ভ্রান্তিমান। এই জন্যে যে, ‘কিম্ভুত’ ও ‘কিমাকার’ সমপর্যায়ভুক্ত পদ নয়। সংস্কৃত ‘কিম্’-এর সহযোগে গঠিত শব্দদ্বয়ের প্রথমটি বিশেষণ এবং দ্বিতীয়টি বিশেষ্য পদের উদাহরণ। এই ‘কিম্’ এমন ধরনের, শব্দের আগে বসে শব্দকে করে ফেলে বিরূপতাপ্রকাশক। উৎপত্তিগত কারণেই দুটোকে একসাথে বিশেষণ নয়, বিশেষ্য পদও বলা যাবে না। কিম্ভুত = কিম্ + ভূত। কিম্ মানে ‘কি’ আর ভূত মানে ‘যা হয়েছে’। শব্দটিতে কিম্ ‘কিরূপে’ প্রশ্ন নিয়ে বর্তমান, যার জবাব বিশেষণ পদ কামনাকারী, এমন বিশেষণ যা ঐ বিরূপতাপ্রকাশক। ভূত এর উদ্দেশ্য পূরণ হয়েছে। এ হিসেবে ‘কিম্ভুত’ এর অর্থ অদ্ভুত। সুধীন্দ্রনাথ দত্ত ‘অদ্ভুত’এর সমার্থক শব্দ হিসেবে এর ব্যবহার করেছেন। যেমন, ‘ওরে কিম্ভুত! নব্যবর্বরতা’। কিমাকার = কিম্ + আকার। এখানেও কিম্ মানে ‘কি’ এবং আকার মানে ‘আকৃতি’। কিন্তু এই কিম্ ‘কী রূপের’ প্রশ্ন নিয়ে বর্তমান, যার উত্তর বিশেষ্য পদ কামনাকারী, এমন বিশেষ্য যা-ও ঐ বিরূপতাপ্রকাশক। আকার এর উদ্দেশ্য পূরণ করেছে। এ-হিসেবে কিমাকারের অর্থ, অদ্ভুত আকার। বলতে চাচ্ছি, ‘কিম্ভুত ও কিমাকার’ নয়, ‘কিম্ভুত কিমাকার’ই ন্যায্য পদবিন্যাস। শব্দদ্বয়ের উৎপত্তি ও গঠন সম্পর্কে না জানার কারণে সোহেল হাসান গালিব ভুলটা করেছেন। তাছাড়া এ-কবিতায় ব্যবহৃত শব্দগুলোর মধ্যে ঐক্য নেই। উদ্ধৃতি তুলে ধরে দেখানো যাক-
(ক) ‘সমুদ্রের ফেনিল জায়নামাজের ঢেউয়ের পরে খাবে লুটোপুটি,
সেজদা থেকে উঠে দাঁড়াবে তিমি
খিন্ন খিজিরের স্বপ্ন সম্মুখে’
এবং
(খ) ‘কিন্নর বিভ্রম যার!
দেবী, তুমি কি তোমার কণ্ঠ শুনতে পাও!
শুনতে কি পাও তোমার সঙ্গীতে
এক বন্দি দানবের হাসি, হাহাকার?’
‘দেবী’ ও কিন্নর’-এর সাথে ‘জায়নামাজ’, ‘সিজদা’ ও ‘খিজির’ মোটেই যায় না। দেবী হলেন দুর্গা বা পরমেশ্বরী, যাকে নিয়ে হিন্দুধর্মচার। কিন্নর হচ্ছে পুরাণোক্ত দেবলোকের সুকণ্ঠ গায়ক। দুটোই সনাতনী। উল্লেখিত বাকি শব্দগুলো ইসলামধর্মসাপেক্ষ। যা হোক, ক্রীতদাসের হাসি’ যে বার্তা বহন করছে, তা নতুন কিছু নয়। সমস্যাযুক্ত শব্দ ও পঙ্ক্তির সমাহার রেখে সোহেল হাসান গালিব বলতে চেয়েছেন, তিনি আরব্য রজনীর দৈত্যের মতো অসীম ক্ষমতার অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও দেবীর দেহের কোটরে কোঠায় বন্দী, হুকুমের দাস।
কবি নির্ঝর নৈঃশব্দ্যের যে কবিতা রয়ছে, তার শিরোনাম নেই। সম্পাদকের অমনোযোগিতার কারণেই হয়তো এমন হয়েছে। নিখুঁত সম্পাদনা সম্পাদকের একাগ্র মনোযোগিতা দাবি করে। ‘৩’ চিহ্নিত অংশে বৃত্তস্থ বৃত্ত, ধাঁধাময় ভূমিজাল, বৃত্তাকার পুকুরের দুপুরচুরি এবং ঠান্ডা কোমল জলে দুপুরের ঝরে পড়া উল্লেখের মাধ্যমে যে-দৃশ্য দাঁড় করানো হয়েছে, তাকে কবিতার মনে হয়েছে। কেনো কবিতা মনে হয়েছে, তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারছি না। কবিতা এমনও: বোঝা যায়, কিন্তু ব্যাখ্যা করা যায় না। তবে এ অংশকে বেশির ভাগ পাঠক পাথর বলে ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারেন। একই কথা তার ‘৪’ চিহ্নিত অংশের ব্যাপারেও। শুধু এইটুকু, কবিতায় দৃশ্য থাকতে পারে- দৃশ্যের মাধ্যমে পাঠককে বোধগ্রস্ত করার ক্ষমতা থাকতে হবে।
   ...